শিয়ালের কাছে আর কুমিরের বাচ্চা দেওয়া যাবে না: মির্জা ফখরুল

নোয়াখালীতে বিএনপির পদযাত্রার পূর্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শুক্রবার বিকেলে শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামে
ছবি: প্রথম আলো

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এই দেশের মানুষ বুঝে গেছে, শিয়ালের কাছে আর কুমিরের বাচ্চা দেওয়া যাবে না। বারবারই খেয়ে ফেলবে। ২০১৮ সালে শেখ হাসিনা আমাদের ডেকে বললেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। সবাই ভোট করতে পারবেন। সবাইকে ভোট করতে বলেন। তিনি কোনো বাধা দেবেন না। আমরা ভাবলাম শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। ভূতের মুখে রামনাম। আমরা ফেঁসে গেলাম। উনি ভোট করলেন আগের রাতে। আবার এখন বলছেন সুন্দর ভোট করবেন। ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন হবে। আহারে...কী আবদার।’

আজ শুক্রবার বিকেল চারটার দিকে নোয়াখালীতে বিএনপির পদযাত্রার আগে শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামে সমাবেশে উপস্থিত নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন। মির্জা ফখরুল বলেন, ‘তাই এবার বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষ জেগে উঠেছে। সাধারণ মানুষ জেগে উঠেছে। শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন নয়, এক দফা এক দাবি।’

বিএনপি মহাসচিব এক দফার আন্দোলনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘এই দাবি আমরা কেন করেছি? কারণ, এখন যে সরকার বসে আছে, তারা কি জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার? না। আপনারা ভোট দিতে পেরেছিলেন? না। ২০১৪ সালে কোনো নির্বাচনই হয়নি। কোনো নির্বাচন ছাড়া ১৫৪ জনকে তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি ঘোষণা করে দিল। তারপর তারা পার্লামেন্টে গিয়ে নতুন নতুন আইন তৈরি করে আরও অত্যাচার–নির্যাতন বাড়িয়ে দিল। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে পুলিশ, র‍্যাব এমনকি বিচার বিভাগকে পর্যন্ত ব্যবহার করে সরকার এই দেশের মানুষের সব অধিকারকে কেড়ে নিয়ে গেছে। আমরা কথা বললেই মামলা। না বললেও মামলা। গায়েবি মামলা। সারা দেশে দেড় লাখ গায়েবি মামলা করেছে। ৪০ লাখ মানুষকে গায়েবি মামলার আসামি করা হয়েছে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা হরতাল করিনি। আমরা অবরোধ করিনি। আমরা মনে করছি, এখন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই সরকারকে ফেলে দেব। এই পদযাত্রা করে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করব ইনশা আল্লাহ।’

নোয়াখালীতে বিএনপির পদযাত্রার পূর্বে সমাবেশে উপস্থিত নেতা–কর্মীদের একাংশ। শুক্রবার বিকেলে শহীদ ভুলু ষ্টেডিয়ামে

গুমের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘কিছুক্ষণ আগে এখানে মুন্নার মা (বিমানবন্দর থানা ছাত্রদল নেতা নিজাম উদ্দিন মুন্না) আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর ছেলে ১২ বছর ধরে গুম হয়ে আছে। আমাদের লাকসামের হিরু এমপি (কুমিল্লা-১০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরু) ছিল, গুম হয়ে গেছে। উত্তরায় আমার প্রতিবেশী ছিল মুন্না। সে ২০১২ সালে গুম হয়ে গেছে। তাকে খুঁজতে খুঁজতে তার বাবা মারা গেছেন। তার মা এখনো প্রতিদিন আমাকে ফোন করে ছেলেটার কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে কি না জানতে চান। এভাবে অসংখ্য মা তার ছেলের জন্য অপেক্ষা করছেন। অসংখ্য স্ত্রী তাঁর স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছেন। অসংখ্য শিশু ভাবে, কখন তার বাবা ফিরে আসবে।’

কৃষকদের দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আজকে আমাদের কৃষক ভাইয়ের অনেকেই এখানে এসেছেন। আজকে আমাদের কৃষক ভাইদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। আগে সারের দাম ছিল ৩০০ টাকা বস্তা। এখন ১ হাজার ২০০ টাকার ওপরে। সব সারের দাম বেড়ে গেছে। বিদ্যুতের দাম তিন গুণ, চার গুণ, পাঁচ গুণ বাড়ছে। ডিজেলের দাম বেড়ে গেছে। যার ফলে সেচ দিতে পারেন না। বীজের দাম বেড়ে গেছে। আর যখন বাজারে বিক্রি করতে যান, তখন দাম পান না। আমাদের শ্রমিকেরা আজকে বাজারে যেতে পারেন না। চাল কিনতে পারেন না। ১০ টাকা কেজিতে চাল দেবে বলেছিল। আজকে সেই চাল, ডাল সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এই সকারের লোকজন হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। ব্যাংকগুলোকে খালি করে দিয়েছে লুটপাটের মাধ্যমে।’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা বলেছি যে শেখ হাসিনার অধীনে, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাব না। তিনি (ওবায়দুল কাদের) বলেছেন, শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। কী আবদার। কী আবদার। আমার ভোট চুরি করে নিয়ে গেলেন! ভোটার যদি বলেন, বিএনপিকে ভোট দেবেন, বলেন ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। আমরা সেই ভোটে যাইনি।’

নোয়াখালীতে বিএনপির পদযাত্রায় দলীয় নেতা–কর্মীদের ঢল। শুক্রবার বিকেলে শহীদ ভুলু ষ্টেডিয়ামের মাইজদী-চৌমুহনী সড়কে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাতে সুবর্ণচরে নারীর ওপর নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘গত নির্বাচনের পর আমি আপনাদের এখানে আরেকবার এসেছিলাম। আপনাদের সুবর্ণচরের মা তিনি কিছুক্ষণ আগে আপনাদের এখানে কথা বলেছিলেন। শুধু ধানের শীষে ভোট দেওয়ার অপরাধে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছিল তাঁর ওপর। তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।

কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্যাহ বুলু বলেন, ‘১২ জুলাই পল্টনের সমাবেশে আমাদের নেতা মির্জা ফখরুল যে ঘোষণা দিয়েছেন, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। আমাদের দাবি আজকে লাখো কোটি মানুষের দাবি। বাংলাদেশের মানুষের দাবি একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন। আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব।’

আরেক ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান বলেন, ‘আমাদের দাবি একটা, আমরা শেখ হাসিনার সরকারকে আর ক্ষমতায় দেখতে চাই না। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন–সংগ্রাম চালিয়ে যাব, যত দিন এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করা হবে না।’

সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সভাপতি হাসান জাফির তুহিন। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবেদীন ফারুক, বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার প্রমুখ। পদযাত্রা মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীম প্রমুখ, জেলা বিএনপির সভাপতি এ জেড এম গোলাম হায়দার, সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান প্রমুখ। পদযাত্রার সমন্বয় করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এ জেড এম জাহিদ হোসেন।