একসময় পাহাড়ি স্বচ্ছ জলধারা প্রবাহমান ছিল বালুটিকর খালে। এটি ছিল সিলেট সদর উপজেলার খাদিমপাড়া ইউনিয়নের তিনটি হাওরের বোরো ধানের পানির একমাত্র উৎস। খালের সুপেয় পানি দিয়ে খাবার রান্না, গোসল ও মাছ শিকার করে চলতেন আশপাশের কয়েক গ্রামের লোকজন। এখন খালের পানি দিয়ে এসব কাজ চালানো তো দূরের কথা, পাশ দিয়ে দুর্গন্ধে হাঁটাও দায়। মৃতপ্রায় খালটি এখন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, খালের পানি আলকাতরার রং ধারণ করে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। লোকজন নাক চেপে খালের পাশ দিয়ে চলাচল করছেন। ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের অভিযোগ, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের (বিসিক) খাদিমনগরের বিভিন্ন কারখানার ময়লা-আবর্জনা ও বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য বালুটিকর খালে মেশার কারণেই এই করুণ দশা তৈরি হয়েছে। এ খাল থেকে পানি নিয়ে জমিতে ফেললে সবজি ও ধানগাছ কয়েক দিন পর মরে যাচ্ছে।
খাদিমপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আফছর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, বিসিকের পরিবেশদূষণ খাদিমপাড়া ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী গোলাপগঞ্জ উপজেলা পর্যন্ত পৌঁছেছে। শুধু বালুটিকর খাল নয়, দূষণ থেকে সুরমা নদীও রেহাই পাচ্ছে না। খাদিমপাড়া এলাকায় এখন ধান ও সবজি চাষ হয় না। দুর্গন্ধ ও মশার উপদ্রব মানুষের সহ্যের বাইরে চলে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সিলেট শহরতলির খাদিম চা-বাগান ও বুড়জান চা-বাগানের পাহাড়ি এলাকা থেকে নেমে আসা লালিছড়াটি খাদিম বিসিকের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নাম ধারণ করেছে নীলবাড়ি ছড়া। পরে খাদিমপাড়া ইউনিয়নের দাশপাড়া, কল্লগ্রাম, বালুটিকরসহ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বালুটিকর খাল নামে কুশিগাঙের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। আর কুশিগাঙ পরে কুশিঘাট হয়ে সুরমা নদীতে গিয়ে মিশেছে।
বালুটিকর গ্রামের বাসিন্দা আবরু মিয়া (৫০) বলেন, এ খাল ছাড়া বিসিকের বর্জ্য ও রাসায়নিক বর্জ্য ফেলার অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। বিসিকের সব ময়লা-আবর্জনা ও রাসায়নিক বালুটিকর খাল দিয়ে কুশিগাঙে গিয়ে পড়ে। গত এক দশক থেকে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ জমে খালটি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে খালের পানির দুর্গন্ধ বাতাসে ছড়ালে রাস্তা দিয়ে চলাচল করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি দুর্গন্ধে আশপাশের বাসাবাড়িতে থাকাও কঠিন হয়ে পড়ে।
বালুটিকর খালের পানি খাদিমপাড়া ইউনিয়নের দশপাড়া, বালুটিকর, বংশীধর ও কল্লগ্রামের মানুষের বোরো ফসল সেচের একমাত্র উৎস বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা বাচন মিয়া (৫৫)। তিনি বলেন, সাত থেকে আট বছর ধরে খালের পানি জমিতে দেওয়ার দুই থেকে তিন দিন পরই ধানগাছ লাল রং হয়ে মরে যায়। খালের বিষাক্ত পানির জন্য স্থানীয় ডেফ, ইলাম ও পাটাজুরি হাওরের বোরো ফসল ফলানো যাচ্ছে না। এ জন্য অনেক কৃষক জমি চাষ ছেড়ে দিচ্ছেন।
খাদিমপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আফছর আহমদ বলেন, ‘এ সমস্যা সমাধানের জন্য শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং বিসিকের কর্মকর্তাদের নিয়ে অনেকবার বসেছি। কিন্তু বিসিক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে না।’
খাদিমনগর বিসিক সূত্রে জানা যায়, বিসিকের ৭৪টি কারখানার মধ্যে ৬৫টি কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম চালু রয়েছে। এর মধ্যে বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ স্থাপনা (অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট-ইটিপি) বাধ্যতামূলক, এ রকম ১২টি কারখানা রয়েছে। তবে এর মধ্যে ছয়টি কারখানার ইটিপি নেই।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, খাদিম বিসিকে যেসব প্রতিষ্ঠানের ইটিপি বাধ্যতামূলক, তার বেশির ভাগের ইটিপি আছে। যাদের ইটিপি করা হয়নি, তাদের দ্রুত তা করার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। তবে বালুটিকর খালের পরিবেশদূষণের বিষয়টি তাঁর জানা নেই। এটি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন বলে তিনি জানান।
বিসিকের ভারপ্রাপ্ত উপমহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সুহেল হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, বালুটিকর খালের পানিদূষণের জন্য শুধু খাদিমনগর বিসিকের বর্জ্য দায়ী নয়। বিসিকের বাইরে এ এলাকায় অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি–বেসরকারি কার্যালয় আছে। সব কটির ময়লা-আবর্জনা এ খালে ফেলা হয়। এ ছাড়া স্থানীয় লোকজন বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা এ খালেই ফেলেন।
কারখানার ইটিপি প্রসঙ্গে সুহেল হাওলাদার বলেন, ইটিপি বাধ্যতামূলক যে ১২টি প্রতিষ্ঠানে, তার মধ্যে ৬টির ইটিপি করা হয়েছে। বিসিক এলাকায় স্থান সংকটের জন্য বাকি ছয়টির ইটিপি করতে দেরি হচ্ছে। তবুও ইটিপি করতে প্রতিনিয়ত তাদের চাপ দেওয়া হচ্ছে।