হত্যাকাণ্ডের পর এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে নরসিংদীর রায়পুরায় সোনাকান্দি গ্রামের প্রবেশমুখে
হত্যাকাণ্ডের পর এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে নরসিংদীর রায়পুরায় সোনাকান্দি গ্রামের প্রবেশমুখে

‘চোখের সামনেই ছেলেডারে গুলি করল, চোখের সামনেই মরতে দেখলাম’

নরসিংদীর রায়পুরায় দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে সাগর ভূঁইয়া (২০) নামের এক তরুণ নিহত হওয়ার ৩৬ ঘণ্টা পরও মামলা হয়নি। এ ঘটনায় পুলিশ কাউকে শনাক্ত বা আটকও করতে পারেনি।

নিহত সাগর ভূঁইয়া উপজেলার নিলক্ষা ইউনিয়নের সোনাকান্দি গ্রামের জয়নাল ভূঁইয়া ও আনোয়ারা বেগমের ছেলে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় অবস্থা তাঁদের। ছেলে হারানোর শোকের পাশাপাশি সংসার কীভাবে চলবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তাঁরা।

গতকাল বুধবার ভোরে সোনাকান্দি গ্রামের আমিরাবাদ এলাকায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে প্রতিপক্ষের গুলিতে বিদ্ধ হয়ে সাগর ভূঁইয়া (২০) নিহত হন। তিনি টাইলস ফিটিংসের কাজ করতেন।

হত্যাকাণ্ডের পর নিলক্ষা ইউনিয়নের ছনপাড়া এলাকায় সোনাকান্দি গ্রামের প্রবেশমুখে অবস্থান নিয়েছেন রায়পুরা থানার পুলিশ সদস্যরা। আজ বৃহস্পতিবার গিয়ে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যরা কাউকে ভেতরে যেতে দিচ্ছেন না, কাউকে বের হতেও দিচ্ছেন না। সেখান থেকে সোনাকান্দি গ্রামের হাঁটাপথের দূরত্ব ৩০ মিনিট। নদীবেষ্টিত প্রত্যন্ত চরাঞ্চল হওয়ায় সংঘর্ষের পরপরই গ্রামের অধিকাংশ পুরুষ এলাকা ছেড়েছেন। যাঁরা এখনো গ্রামে রয়েছেন, গ্রেপ্তারের ভয়ে তাঁরাও ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।

ওই এলাকার অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, এলাকায় বসবাস করা প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো দলে শরিক থাকতে হয়। কিছুদিন আগেও হান্নান মিয়া ও তৌকির মিয়া একদলে ছিলেন। নদীতে বালুমহালের ভাগ-বাঁটোয়ারার দ্বন্দ্বে তাঁরা দুজন আলাদা হয়ে যান। তৌকির নতুন দল গঠন করলে হান্নানের দলের শক্তি কিছুটা কমে যায়। এরপরই কৌশলগত কারণে তাঁর দীর্ঘদিনের প্রতিপক্ষ রাজীব সরকারের সঙ্গে হাত মেলান হান্নান। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হান্নান-রাজীব মিলিত হলে তৌকিরের দলের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মঙ্গলবার রাতভর দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা চলে। গতকাল ভোরে দুই পক্ষ দেশি অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে তৌকির পক্ষের সাগর (২০) নিহত এবং হান্না (২২) নামের একজন আহত হন। এ ছাড়া সংঘর্ষে ২০-২৫ জন আহত হন এবং ১০টি বাড়িতে আগুন লাগে।

সাগর ভূঁইয়া

সাগরের মা আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘ঘটনার দিন (বুধবার) ভোরে দলের লোকজন ঝগড়ায় যাইতে আমার শোয়া ছেলেকে আইসা ডাকে। আমিও লগে লগে যাই। একটা বাড়িত যাওয়ার পর দেহি আরও অনেক লোক হেন ঝগড়ার লাইগ্যা রেডি হইতাছে। ইতা দেইখা হে আমারে কয়, “এইতা ঝগড়ার মইধ্যে আমি থাকতাম না, আমাকে এহান থাইক্যা বাইর কইরা দেও।” তহনই আমি তারে লইয়্যা রাস্তা ধইরা হাঁটতে শুরু করি। ওই রাস্তায় গোলাগুলির শব্দ শুইন্যা অন্য রাস্তা ধরি। পথে আমগরে আটকায় হান্নান-রাজীবের দলের লোকজন। তাদের মুখ ঢেকে রাখা, বাঁচার লাইগ্যা আরেক বাড়ির পাকঘরে লুকাই। তারা হেন যাইয়্যা কিছু কওয়ার আগেই বন্দুক বাইর কইরা আমার ছেলের মাথায় গুলি কইরা দেয়। ছেলে আমার মাটিতে পইড়া গেলে তারা হগলতে চইলা যায়। তারে চাইপা ধইরা সিএনজিতে কইরা হাসপাতালে রওনা হই।’

আনোয়ারা বেগম আরও বলেন, ‘সাড়ে ৬টার সময় তারে (সাগর) নিয়া হাসপাতালে (১০০ শয্যার নরসিংদী জেলা হাসপাতাল) যাই। তহনো বাঁইচা আছিল আমার ছেলে। আমি ডাক্তারের হাতে-পায়ে ধরছি, তবু তারা খাতিরজমা এইডা করে, সেইডা করে, চিকিৎসা আর করে না। এক ঘণ্টা ধইরা এইতা করতে করতেই আমার ছেলে মইরা গেল। আমার চোখের সামনেই ছেলেডারে গুলি করল, চোখের সামনেই তারে মরতে দেখলাম।’

এ বিষয়ে জানতে হান্নান মিয়া, রাজীব সরকার ও তৌকির মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁদের মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। হত্যাকাণ্ডের পর থেকে তাঁরা এলাকায় নেই।

নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গে লাশের ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল দুপুরে পরিবারের সদস্যদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। পরে বিকেলে নিজ গ্রামে সাগরের লাশ দাফন করা হয়। তাঁর মা আনোয়ারা বেগম জানান, গতকাল রাতে পুলিশ এসে অভিযোগ শুনেছে। কাগজে লিখে তাঁর সই নিয়েছে।

রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাফায়েত হোসেন বলেন, পুরো এলাকা পুরুষশূন্য হয়ে আছে। সংঘর্ষে জড়িত ব্যক্তিদের ধরতে অভিযানও চলছে। দ্রুতই মামলা হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।