বরেণ্য চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের রাজশাহীর পৈতৃক বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. মহিনুল হাসান। পরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে চলচ্চিত্রকর্মীদের হাতেও একই প্রতিবেদনের কপি তুলে দেন তিনি।
প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় মহিনুল হাসান শুধু বলেন, এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক পরবর্তী পদক্ষেপের কথা বলবেন। প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর একজন চলচ্চিত্রকর্মী সেখানেই অন্যদের পড়ে শোনান। তদন্ত প্রতিবেদনকে অগ্রহণযোগ্য পক্ষপাতদুষ্ট আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করেন তাঁরা।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর নগরের মিঞাপাড়ায় ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি ভাঙা হয়। ভাঙার আগে সিসিটিভি বন্ধ রাখা হয়। বাড়িটির পশ্চিম পাশে রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকার বাড়ির ৩৪ শতাংশ জমি কলেজকে ইজারা দেয়। ২০১৯ সালে বাড়িটির একাংশ ভেঙে সাইকেলের গ্যারেজ তৈরির অভিযোগ উঠলে রাজশাহীসহ সারা দেশে প্রতিবাদ জানানো হয়। পরে ২০২০ সালে বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় জেলা প্রশাসন। ভূমি মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠিও পাঠায়। এবার তা সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এবার চলচ্চিত্রকর্মীরা হোমিওপ্যাথিক কলেজের বিরুদ্ধে ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি ভাঙার অভিযোগ এনেছেন। এ ঘটনায় দায়ীদের শাস্তিও চাচ্ছেন তাঁরা। ১৪ আগস্ট বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার খবর পেয়ে গতকাল জড়ো হন রাজশাহীর চলচ্চিত্রকর্মীরা। এ সময় কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চলচ্চিত্রকর্মীদের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়েছে বলে ঠিকাদার দাবি করেন।
তবে কলেজের অধ্যক্ষ বলছেন, তাঁদের সাবেক শিক্ষার্থীরা এটা ভেঙে ফেলেছেন। সেদিনই ইয়ুথ অ্যাকশন ফর সোশ্যাল চেঞ্জ-ইয়াস রাজশাহী জেলা প্রশাসককে ঘটনায় দোষীদের বিচারের দাবিতে স্মারকলিপি দেন। সেদিনই অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
আট পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হোসেন (মাসুদ), ইয়ুথ অ্যাকশন ফর সোশ্যাল চেঞ্জ-ইয়াসের সভাপতি শামীউল আলীম, সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান, কলেজের অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান, কলেজের নিরাপত্তাকর্মী মোজ্জামেল হোসেন ও বাড়ি ভাঙার কাজের ঠিকাদার শামীম মিয়ার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। তাঁদের প্রত্যেকের বয়ান তুলে ধরার পর তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন তুলে ধরেন। পরে তিনি একটি পর্যালোচনা দেন।
সার্বিক মন্তব্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক উল্লেখ করেন, ৬ আগস্ট রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের অভ্যন্তরে ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বসতভিটার উত্তর পাশের পুরো দেয়াল, দক্ষিণ–পশ্চিম কর্নারের আংশিক দেয়াল এবং বঙ্গবন্ধু কর্নারের ভেতরের দেয়াল ভাঙার সঙ্গে কলেজ কর্তৃপক্ষের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি। পরে ৭ আগস্ট থেকে পরবর্তী সময়ে ভবনের বাকি তিনটি দেয়াল কলেজের শিক্ষক, কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও চিকিৎসা গ্রহণকারীদের ঝুঁকি বিবেচনায় ভবনটির অবশিষ্ট অংশ ভেঙে স্তূপ করে রাখার বিষয়টি স্বীকার করেছে। এতে ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতি সংরক্ষণের বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের অবহেলা প্রমাণিত হয়।
প্রতিবেদনে তিনটি সুপারিশের কথা উল্লেখ করা হয়। ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতিবিজড়িত স্থানটি স্থানীয়ভাবে ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির নামে মালিকানা দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা; স্থায়ী মালিকানা না পাওয়া পর্যন্ত হোমিওপ্যাথিক কলেজ কর্তৃপক্ষের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। আগামী ৪ নভেম্বর ঋত্বিক ঘটকের জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের জন্য জায়গাটি প্রস্তুত করা এবং এ জন্য ঋত্বিক মঞ্চ ও ঋত্বিক সংরক্ষণাগার দ্রুত নির্মাণের ব্যবস্থা করা। এটি কলেজ কর্তৃপক্ষ রক্ষণাবেক্ষণ করবে এবং ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটি নির্বিঘ্নে ব্যবহার করবে; স্থায়ী মালিকানা পাওয়ার পর মালিক কর্তৃপক্ষকে কলেজের সুবিধা ও অসুবিধা বিবেচনায় নিয়ে নিজেদের মতো ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হলো।
ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হোসেন বলেন, কলেজ কর্তৃপক্ষ ঐতিহ্যকে হত্যা করেছে। এ বিষয়ে যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে তা অগ্রহণযোগ্য। পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন তাঁরা প্রত্যাখ্যান করছেন। তাঁরা বসে দ্রুতই পরবর্তী পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেবেন। ইয়াসের সভাপতি শামীউল আলীম বলেন, তাঁরা প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করছেন। অনেক কিছুই বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা কঠোর আন্দোলনে যাবেন।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে যেখানে আপত্তি আছে, সেটা লিখে জানালে প্রয়োজনে তাঁরা আরেকজনকে আবার তদন্তের দায়িত্ব দেবেন।