বুধবার বেলা সাড়ে ১১টা। বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথা স্কয়ারের সব কটি সড়কে রিকশা-অটোরিকশা, ইজিবাইক, যাত্রীবাহী বাস আর ব্যক্তিগত গাড়ির বিশাল সারি। সাতমাথাকেন্দ্রিক সব কটি সড়ক ছিল যানজটে স্থবির। ১০ মিনিটেও নড়ছিল না গাড়ির চাকা। প্রখর রোদে যানজটে আটকে থেকে পথচারী ও যাত্রীরা হন নাকাল।
টানা চার দিন ছিল ‘কারফিউ’। তারও আগে কোটা বাতিল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শাটডাউন কর্মসূচির আগে– পরে উত্তাল ছিল বগুড়া। কার্যত ১৬ জুলাই থেকে অচল ছিল শহর। সড়কগুলো ছিল ফাঁকা–জনশূন্য। শহরের দোকানপাট, বিপণিবিতানও ছিল বন্ধ। শাটডাউন ও কারফিউ পরিস্থিতিতে টানা আট দিন ঘরে বন্দি থাকার পর আজ খুলে দেওয়া হয় অফিস-আদালত, ব্যাংক ও বিমা প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কারফিউও শিথিল ছিল। এতে সকাল নয়টার পর থেকেই শহরে মানুষের ঢল নামে। সড়কে বেড়ে যায় যানবাহনের চাপ।
সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত বগুড়া শহরের কলোনি বাজার থেকে শুরু করে কালীতলা পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার অংশজুড়ে ছিল ভয়াবহ যানজট। দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা শহরের ঠনঠনিয়ার ভাইপাগলার মাজারসংলগ্ন পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে, ঠনঠনিয়া কোচ টার্মিনালের সামনে, মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের সামনে, পিটিআই মোড়, মফিজ পাগলার মোড়, ইয়াকুবিয়া স্কুল মোড়সহ শহরের প্রধান সড়কে ছিল রিকশা-অটোরিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়ির দীর্ঘ সারি।
এ ছাড়া যানজটে স্থবির ছিল সূত্রাপুরের ঘোড়াপট্টি মোড়সহ সাতমাথায় সবগুলো সড়কের মোহনা। একই অবস্থা ছিল কবি নজরুল ইসলাম সড়ক, থানা মোড়, ঝাউতলা, বড়গোলা, দত্তবাড়ী ও কালীতলা এলাকা। শহরের স্টেশন সড়ক এবং জলেশ্বরীতলা শহীদ আবদুল জব্বার সড়ক ও রোমেনা আফাজ সড়কেও ছিল দুপুর পর্যন্ত যানজটের এমন চিত্র। যানজট নিরসনে শহরে ছিল না ট্রাফিক পুলিশের কোনো তৎপরতা। ট্রাফিক পুলিশ যানজট নিয়ন্ত্রণের বদলে ব্যস্ত ছিল অপরাধ দমন দায়িত্ব পালনে।
জানতে চাইলে বগুড়া ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (প্রশাসন) মো. মাহবুবুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, বগুড়া ট্রাফিক বিভাগে ৪৪টি পদ। দেশে চলমান পরিস্থিতিতে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা কয়েক দিন ধরে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করছেন। বুধবার কারফিউ শিথিল হলেও শহরে যানজট নিরসনে ট্রাফিকের কোনো সদস্য ছিলেন না, সবাই ব্যস্ত ছিলেন মানুষের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্বে; কিন্তু শহরে লোকসমাগম ও যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে গেলে কিছু সময়ের জন্য যানজট তৈরি হয়। বাধ্য হয়ে ট্রাফিকের কিছু সদস্যকে শহরের যানজট নিরসনের দায়িত্ব পালনের জন্য ডেকে আনা হয়।
টানা পাঁচ দিন পর আদালত খুলে যাওয়ায় কোর্ট হাউস সড়কে জেলা জজ আদালত ফটকেও ছিল তীব্র যানজট। আদালতে আসা বিচারপ্রার্থী ও আসামির ভিড়ে ঘিঞ্জি এক পরিবেশ তৈরি হয় আদালত চত্বরে। বগুড়া আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবদুল বাছেদ প্রথম আলোকে বলেন, কালীতলা থেকে আদালতে আসতে স্বাভাবিক সময় লাগে পাঁচ মিনিট। কিন্তু শহরের দত্তবাড়ী, ঝাউতলা রেলগেট, কবি নজরুল ইসলাম সড়ক, সাতমাথা—সবখানেই যানজটে স্থবির ছিল। বাসা থেকে আদালতে আসতে ২০ মিনিটের বেশি সময় লেগেছে।
শহরের কলোনি থেকে রিকশায় বড়গোলায় বেসরকারি একটি ব্যাংকে টাকা তুলতে এসে যানজটের ভোগান্তিতে পড়েন ব্যবসায়ী আরিফুজ্জামান আরিফ। তিনি বলেন, রিকশায় কলোনি থেকে বড়গোলা সর্বোচ্চ ১০ মিনিটে পৌঁছার কথা। কিন্তু যানজটে শহর স্থবির, রিকশার চাকা ঘুরছে না। এটুকু পথ আসতে সময় লেগেছে ৪০ মিনিট।
বগুড়া শহরের যানজটের কারণ জানালেন কমিউনিটি পুলিশিংয়ের শহর কমিটির সভাপতি এবং পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র আমিনুল ফরিদ। তাঁর ভাষ্য, পুরোনো জেলা শহরের প্রধান রাস্তার দুই পাশে বিশাল বিশাল বহুতলবিশিষ্ট অট্টালিকা আর বাণিজ্যিক ভবন; কিন্তু এসব ভবন গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলেও বেশির ভাগ ভবনে নেই গাড়ি পার্কিং। ফুটপাত দখল করে গাড়ি পার্ক করা হয়েছে। ফুটপাতে নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন হকার ও ফুটপাতের ছোট ছোট দোকানি। ফলে চলাচলের পথ সরু হওয়ায় নিত্যদিন থেমে থেমে যানজট তৈরি হচ্ছে।
বগুড়া পৌরসভার একটি সূত্র জানিয়েছে, শহরে শুধু প্যাডেলচালিত ৬ হাজার ২০০ রিকশার লাইসেন্স দেওয়া আছে। তবে শহরের রাস্তাঘাট এখন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইকের দখলে। সব মিলিয়ে শহরে ৬০ হাজার ইজিবাইক এবং ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে।