খুলনা-ঢাকা পথে ‘কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন’ চালু, ব্যাপারীরা বলছেন খরচ দ্বিগুণ

খুলনা থেকে ঢাকার পথে চালু হলো কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন। মঙ্গলবার সকালে খুলনা স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার আগে
ছবি: সংগৃহীত

খুলনা অঞ্চলের সবজি, ফুলসহ কৃষিপণ্য ঢাকায় নেওয়ার জন্য আজ মঙ্গলবার থেকে সপ্তাহে এক দিন ‘কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন’ নামে নতুন একটি বিশেষ ট্রেন চালু হয়েছে। আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে খুলনা স্টেশন থেকে সাপ্তাহিক এই বিশেষ ট্রেনটির শুভ উদ্বোধন করা হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের (পশ্চিমাঞ্চল) মুখ্য বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক সুজিত কুমার বিশ্বাস উদ্বোধন ঘোষণা করেন। খুলনা থেকে যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, ভেড়ামারা হয়ে ট্রেনটি অন্তত ১০ ঘণ্টা পর ঢাকায় পৌঁছাবে।

এই ট্রেনে সাতটি বগি (লাগেজ ভ্যান) রয়েছে। এর মধ্যে একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ও অপর ছয়টি সাধারণ বগি। অত্যাধুনিক লাগেজ ভ্যানে কৃষিপণ্য; অর্থাৎ ফল, সবজি ছাড়াও রেফ্রিজারেটেড লাগেজ ভ্যানে হিমায়িত মাছ, মাংস ও দুধ পরিবহনের রেলওয়ের এই বিশেষ সেবা চালু হলো। সবজিমালিকদের ঢাকায় যাওয়ার জন্য ২০টি চেয়ার রয়েছে। তাঁদের বিনা ভাড়ায় যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।

এই ট্রেনে প্রতি কেজি কৃষিপণ্যে ভাড়া খুলনা থেকে ঢাকা পর্যন্ত ১ টাকা ৪৭ পয়সা, যশোর থেকে ঢাকা পর্যন্ত ১ টাকা ৩৫ পয়সা, চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকা পর্যন্ত ১ টাকা ৩০ পয়সা, ঈশ্বরদী থেকে ঢাকা পর্যন্ত ১ টাকা শূন্য ৮ পয়সা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে।

প্রথম দিন যশোরের সবজি উৎপাদন অঞ্চল বলে খ্যাত বারীনগর ও চূড়ামনকাটি এবং ফুল উৎপাদন অঞ্চল গদখালী থেকে এই ট্রেনে কোনো সবজি বা ফুল পাঠানো হয়নি। যশোর থেকে যেসব ব্যবসায়ী সবজি ঢাকায় পাঠান, তাঁদের দাবি, ট্রাকে যশোর থেকে ঢাকায় সবজি পাঠাতে প্রতি কেজিতে খরচ পড়ে দুই টাকা। সেখানে ট্রেনে করে পাঠাতে প্রতি কেজিতে সাড়ে চার টাকার মতো খরচ হবে। এ ছাড়া তিন থেকে চারবার সবজি ওঠাতে–নামাতে বেশি পরিমাণ নষ্ট হবে। যে কারণে ট্রেনে করে সবজি ঢাকায় নেওয়া বাস্তবসম্মত হবে না বলে তাঁদের দাবি।

যশোর থেকে এই ট্রেনে কোনো সবজি না নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে যশোরের বারীনগর সবজি মোকামের ব্যাপারী আন্তার আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যশোর থেকে ট্রেনে সবজি ঢাকায় নেওয়া বাস্তবসম্মত হবে না। কারণ হলো, বারীনগর হাট থেকে রেলওয়ে স্টেশনে এবং ঢাকার রেলওয়ে স্টেশন থেকে কারওয়ান বাজার ও যাত্রাবাড়ী বাজারে সবজির আড়তে নিতে পরিবহন ও শ্রমিক খরচ বাড়বে। এ ছাড়া বারবার পণ্য ওঠানো-নামানোর কারণে নষ্ট (ওয়েস্টেজ) বেশি হবে। সময়ও লাগছে ১০ ঘণ্টার বেশি। এতে প্রতি কেজিতে সাড়ে চার টাকার মতো পরিবহন খরচ হবে। অন্যদিকে ট্রাকে প্রতি কেজি ২ টাকা খরচে গন্তব্যে পৌঁছানো যাচ্ছে। মাত্র চার ঘণ্টায় ট্রাক ঢাকায় পৌঁছে যাচ্ছে। এতে সবজিও সতেজ থাকছে।’

কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেনটি চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে আসার পর সবজি নিয়ে একমাত্র যাত্রী হিসেবে ওঠেন ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম। মঙ্গলবার দুপুরে

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ বলেন, প্রাথমিকভাবে আজ ট্রেনটি চালু করা হয়েছে। যশোরের সবজি ও ফুলচাষিদের জন্য কার্যকর না হলেও খুলনা, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় স্টেশনসংলগ্ন যেসব সবজির মোকাম আছে, তাদের জন্য কার্যকর হবে বলে তিনি জানান।

ট্রেনে পণ্য পরিবহন খরচ কমানোর বিষয়ে  হারুন অর রশিদ বলেন, ট্রেনে সবজি পরিবহন ভাড়া কমানো বা বাড়ানো উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। যশোর থেকে প্রতি কেজিতে সাড়ে ৪ টাকা খরচের যে বিষয়টি বলা হচ্ছে, সেটি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হবে।

বিশেষ এই ট্রেন চুয়াডাঙ্গার সবজি উৎপাদনকারী কৃষক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যেও তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। উদ্বোধনের প্রথম দিনে চুয়াডাঙ্গায় বেলা ১টা ৩০ মিনিটে আসার কথা থাকলেও ৩৫ মিনিট বিলম্বে ২টা ৫ মিনিটে এসে পৌঁছায় এবং ৮ মিনিট পর ছেড়ে যায়। এদিন চুয়াডাঙ্গা স্টেশন থেকে সিরাজুল ইসলাম নামের একজন ব্যবসায়ী ৭৮ টাকা ভাড়া দিয়ে ৬০ কেজি সবজি (পটোল ও ঢ্যাঁড়স) ঢাকা পর্যন্ত বুক করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা পর্যন্ত বুক করলেও ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম তাঁর সবজি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় নামান। ওই ব্যবসায়ীর একজন ঘনিষ্ঠজন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ব্যবসায়ী সিরাজুল সপ্তাহে ৭ দিনই খুলনা-সৈয়দপুর পথের রকেট ট্রেনে চুয়াডাঙ্গা থেকে সবজি নিয়ে ভেড়ামারা গিয়ে নামেন। তবে আজ রেলওয়ে কর্মকর্তাদের ‘জোরাজুরিতে’ তিনি ‘কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেনে’ চড়েন। রকেট ট্রেন চুয়াডাঙ্গা থেকে আজ বেলা ১টা ৫০ মিনিটে সৈয়দপুর পথে ছেড়ে যায়। আর কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে আসে বেলা ২টা ৫ মিনিটে।

এই ট্রেনে একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ও অপর ছয়টি সাধারণ বগি (লাগেজ ভ্যান) রয়েছে। অত্যাধুনিক লাগেজ ভ্যানে কৃষিপণ্য; অর্থাৎ ফল, সবজি ছাড়াও রেফ্রিজারেটেড লাগেজ ভ্যানে হিমায়িত মাছ, মাংস ও দুধ পরিবহনের ব্যবস্থা রয়েছে। সবজিমালিকদের বিনা ভাড়ায় ঢাকায় যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।

কৃষকদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন রিসোর নির্বাহী পরিচালক জাহিদুল ইসলাম বলেন, সরকার কৃষকদের স্বার্থে বিশেষ এই রেলসেবা চালু করলেও সেভাবে প্রচার–প্রচারণা না থাকায় কোনো সাড়া মেলেনি। তিনি দাবি করেন, কৃষক ও ব্যবসায়ীরা পণ্য পরিবহনে যাতে কোনো প্রকার হয়রানির শিকার না হন, সে জন্য একটি নীতিমালা দরকার। বিশেষ করে, পণ্য ওঠানামায় কুলির খরচ নির্ধারণ এবং অনলাইনে পণ্য বুকিং এবং তা বাতিলের সুযোগ রাখতে হবে।

চুয়াডাঙ্গা স্টেশনমাস্টার মিজানুর রহমান বলেন, দুই দিন ধরে ব্যাপক মাইকিং করা হয়েছে। আজ প্রথম দিনে কাঙ্ক্ষিত সাড়া পাওয়া না গেলেও পর্যায়ক্রমে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা যাতে আগ্রহী হন, সে জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে। তাতে সবজির মালিক ও রেলওয়ে উভয় কর্তৃপক্ষ লাভবান হবে।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ট্রেনটি তিন দিন তিনটি রুটে চলাচল করবে। এর মধ্যে খুলনা থেকে যশোর হয়ে ঢাকা; পঞ্চগড় থেকে ঢাকা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহমপুর থেকে ঢাকার মধ্যে সপ্তাহে এক দিন করে এই ট্রেন চলাচল করবে। প্রাথমিক পর্যায়ে এক রুটে সপ্তাহে এক দিন এই বিশেষ ট্রেন চলাচল করবে। প্রয়োজন হলে পরে এটি বাড়ানো হবে। খুলনা থেকে যশোর হয়ে ঢাকায় আজ ট্রেনটি ছেড়ে গেছে।

এদিক এই বিশেষ ট্রেনের সুবিধা-অসুবিধা দেখতে বাংলাদেশ রেলওয়ের (পশ্চিমাঞ্চল) বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন খুলনা থেকে ভ্রমণ করেন। তিনি জানান, ট্রেনের বগিগুলোতে ভেন্টিলেশন ও ফ্যান এবং রাতের বেলা মালামাল ওঠানো-নামানোর জন্য আলোর সুবিধা আছে। এই ট্রেন অন্যান্য আন্তনগর ট্রেনের মতোই ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করবে। ট্রেনের ৭টি ভ্যানে ২৩০ টন পণ্য বহন করা যাবে। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমরা স্থানীয় কৃষক-ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা এবং বাজার কমিটির সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা জানিয়েছেন, যদি সপ্তাহের প্রতিদিন চলে, তাহলে তাঁরা আরও আগ্রহী হবেন। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা বলেছি। তাঁরা জানিয়েছেন, এলাকাবাসী যদি এখানে মালামাল পরিবহন করেন, তাহলে সপ্তাহের সাত দিনই চালানো হবে।’

অনলাইনে বুকিং ও বাতিল প্রসঙ্গে রেল কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন বলেন, ‘অনলাইনের বিষয়ে কার্যক্রম চলমান আছে। আর কুলির বিষয়ে ২০১৯ সালের সরকার নির্ধারিত রেট আছে। সেই তালিকার বাইরে কোনো কুলি কোনো বাড়তি টাকা নেবেন না। যেসব কৃষক ও ব্যবসায়ী বুক করবেন, তাঁদের অনুরোধ করছি, সরকারনির্ধারিত তালিকা দেখে ভাড়া ও কুলির টাকা দেবেন। কেউ যদি অতিরিক্ত টাকা চান, আপনারা তা দেবেন না। বাড়তি টাকা নিলে আমাদের জানাবেন, সেই মুহূর্তেই ব্যবস্থা নেব।’