এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা

‘হঠাৎ টের পাই বাসটি প্লেনের মতো উড়ে সড়ক থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে’

দুর্ঘটনাকবলিত বাসের যাত্রী সাইফুল ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো

মাদারীপুরের শিবচরে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনাকবলিত ইমাদ পরিবহনের বাসটি খুলনার সোনাডাঙ্গা থেকে ছাড়ার আগে চালক ও সহকারী বলাবলি করেন ব্রেক ভালোমতো কাজ করছে না। সেটার ত্রুটি রয়েছে। মেরামত করা প্রয়োজন। তখন চালক বলেছিলেন, ঢাকায় গিয়ে যাত্রী নামিয়ে ব্রেক ঠিক করবেন।

বাসটির আহত যাত্রী সাইফুল ইসলাম এই বর্ণনা দিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টিকে তখন গুরুত্ব দেইনি। বাসটি এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার পর নিয়ন্ত্রণহীন গতিতে চলতে থাকে। হঠাৎ টের পাই বাসটি প্লেনের মতো উড়ে সড়ক থেকে নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে। বাঁচার জন্য বাসের ছিটের নিচে বসে পড়ি। এরপর কিছু সময় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি।’

সাইফুল ইসলাম খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামোদর ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য। দুর্ঘটনার পর তাঁকে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।

সড়ক থেকে বাসটি নিচে পড়ার পড় স্থানীয় মানুষের ভিড়। রোববার সকালে

গতকাল রোববার সকালে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কুতুবপুর এলাকায় পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ে থেকে বাস ছিটকে পড়ে ১৯ জন নিহত হন। দুর্ঘটনাকবলিত বাস থেকে হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় লোকজন। আহত কয়েকজনকে নেওয়া হয় শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও এক্সপ্রেসওয়ের পাশে পাচ্চর এলাকার বেসরকারি একটি হাসপাতালে। চিকিৎসাধীন আহত যাত্রীদের সঙ্গে গতকাল সন্ধ্যায় কথা হয় প্রথম আলোর।

আহত ব্যক্তিদের একজন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার পুইশুর গ্রামের বাসিন্দা উজ্জ্বল সিকদার। তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত। গ্রামের বাড়িতে দুই দিন ছুটি কাটিয়ে গতকাল কর্মস্থলে ফিরছিলেন। ভাটিয়াপাড়ার গোপালপুর কাউন্টার থেকে সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে ইমাদ পরিবহনের বাসে উঠে ঢাকায় রওনা হয়েছিলেন তিনি।

আহত বাসযাত্রী উজ্জ্বল সিকদার

পাচ্চর এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, গোপালপুর থেকে বাসটি ছাড়ার পরই উচ্চগতিতে চালাচ্ছিলেন চালক। ফরিদপুরের ভাঙ্গা মোড় পার হওয়ার পর এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে গতি আরও বেড়ে যায়। তখন অনেক যাত্রী চিৎকার-চেঁচামেচি করছিলেন। অনেকে ঘুমিয়ে ও তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ছিলেন। নারী ও শিশু যাত্রীরা কান্না করেন। চালক তারপরও বাসের গতি কমাচ্ছিলেন না। হঠাৎ বাসটি বাঁক খেয়ে পড়ে যেতে থাকে। রাস্তা থেকে ছিটকে সোজা নিচে পড়ে যায়।

গোপালগঞ্জের ভাটিয়াপাড়া থেকে বাসটিতে উঠেছিলেন সাহাদাৎ হোসেন। আহত অবস্থায় তাঁকেও নেওয়া হয় পাচ্চরের বেসরকারি হাসপাতালটিতে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাসটি অনেক গতিতে চলছিল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি ছিটকে পড়ে যাবে। অনেক যাত্রী হইচই করেছেন। চালক কর্ণপাত করেননি।

সাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘আমি পেছনের ছিটে জানালার পাশে বসে ছিলাম। হঠাৎ দেখি বাসটি সড়ক থেকে উড়ে নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে। বাঁচার জন্য সিট আঁকড়ে ধরি। এরপর আর কিছু মনে নেই। লোকজন আমাকে বাস থেকে বের করে আনেন।’

পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও বাসযাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল ভোরে ইমাদ পরিবহনের ওই বাস খুলনার ফুলতলা থেকে ছেড়ে সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালে আসে। এরপর যাত্রী নিয়ে ভোর ৫টা ৫ মিনিটে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। পথিমধ্যে বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের বিভিন্ন স্টেশন থেকে ঢাকাগামী যাত্রী ওঠানো হয় বাসটিতে। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পদ্মা সেতুর ৪ কিলোমিটার দূরত্বে এক্সপ্রেসওয়েতে কুতুবপুর এলাকায় পৌঁছালে চালক বাসটির নিয়ন্ত্রণ হারান। তখন সড়ক থেকে বাসটি ছিটকে নিচে পড়ে যায়।

কুতুবপুরের এক্সপ্রেসওয়ের নিচে চায়ের দোকান চালান আবদুল হক

এক্সপ্রেসওয়ের নিচে কুতুবপুরের ওই আন্ডারপাস দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা চলাচল করেন। তাঁদের জন্য রয়েছে সার্ভিস সড়ক। সেখানে ২০ থেকে ২৫টি দোকানও রয়েছে। বাসটি ছিটকে ওই আন্ডারপাসের দেয়ালে পড়ে যায়। ওই স্থানের চায়ের দোকানি আবদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সকাল সাড়ে সাতটার দিকে দোকানে কয়েকজন ক্রেতা ছিলেন। হঠাৎ ঘূর্ণিঝড়ের মতো আওয়াজ দিয়ে একটি বাস উড়ে এসে আন্ডারপাসের ওপর পড়ে যায়। প্রথমে তাঁরা আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করছিলেন। পরে উদ্ধারকাজে অংশ নেন।

শিবচর হাইওয়ে থানার উপপরিদর্শক আবদুল্লাহেল বাকী আরেকটি দুর্ঘটনার মৃত ব্যক্তির লাশ উদ্ধারে কাজ করছিলেন এক্সপ্রেসওয়েতে। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ছুটে যান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চাকা ফেটে যাওয়ার কোনো আলামত সড়কে দেখতে পাননি। বাসের বেঁচে যাওয়া যাত্রী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা তেমন কিছু বলেননি। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাসটি উড়ে নিচে আন্ডারপাসের দেয়ালে ধাক্কা লেগেছে।

শিবচর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু নাঈম প্রথম আলোকে বলেন, বাসটির ফিটনেস নেই এমন তথ্য পেয়েছেন। অনেক যাত্রী বলেছেন ব্রেক কাজ করছিল না। চাকা ফেটে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ আছে। আন্ডারপাসের দেয়ালে ধাক্কায় চাকার কিছু অংশ ছিঁড়ে গেছে। চাকার ড্রামটি অক্ষত আছে। চাকা ফেটে গেলে ড্রামটি ভেঙে যাওয়ার কথা। বৃষ্টি থাকায় সড়ক ছিল পিচ্ছিল। অতিরিক্ত গতিতে বাসটি চালানোর কারণে চালক বাসের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি। যার কারণে প্লেনের মতো উড়ে গিয়ে নিচে আছড়ে পড়ে।