চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ বছর আমের ফলন কম হয়েছে। চাষি ও ব্যবসায়ীদের মতে, এবার আমের উৎপাদন ২৫-৩০ শতাংশের বেশি হয়নি। চাষিরা বলেছেন, যাদের বাগানে আমের ফলন হয়েছে, তাঁরা এবার ‘লালে লাল’ (লাভবান)। আর যাদের বাগানে ফলন হয়নি, তাঁরা করছেন হা-হুতাশ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের সবচেয়ে বড় মোকাম শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে। গত শনিবার সেখানে গিয়ে জানা যায়, ১০ জুন আম নামা শুরু হলেও হাট জমেছে ২০ জুন থেকে। ভ্যান, ভটভটির ওপর বড় ডালি ও প্লাস্টিকের ক্যারেটে করে নানা জাতের আম আনা হয়েছে। এমনকি বাইসাইকেলের দুপাশে কায়দা করে রাখা আড়াই মণের বড় ডালিতে সাজানো রয়েছে আম। বাজারের ইট বিছানো বড় মাঠেও আম। দরদাম ঠিক করে বিক্রি হওয়ার পর ভ্যানসুদ্ধ আমের হাটের একদিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার বিক্রি করার জন্য শত শত ভ্যান আরেক দিক দিয়ে ঢুকছে। এই আসা-যাওয়া স্রোতের কারণ হাট-সংলগ্ন কানসাট-সোনামসজিদ সড়কে কিছুক্ষণ পরপরই লেগে যাচ্ছে যানজট। বাজারের বাইরে এই সড়কের পাশে বিভিন্ন স্থানে ও স্থানীয় সড়কের পাশেও বসে চলছে আমের বেচাকেনা।
বাজারে দেখা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মাপারের চর এলাকা সূর্যনারায়ণপুর থেকে ল্যাংড়া আম বিক্রি করতে এসেছেন এনামুল হকের। তাঁর সঙ্গে আম দরদাম করছেন কুষ্টিয়া থেকে আসা সামশুল হক। তিনি বলেন, ৩ হাজার ৬০০ টাকা মণ বলেছেন; কিন্তু দিতে চায় না। গত বছর যে দামে কিনেছেন, এবার দাম চাওয়া হচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশি। এবার ব্যাপারীদের বেশি পুঁজি খাটাতে হচ্ছে।
এনামুল জানান, তিনি ৪ হাজার ৬০০ টাকা চেয়েছেন। এত কম বললে কি দেওয়া যায়? বাড়াতে হবে আরও। এ কথা শুনে সামশুল আর সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে গেলেন অন্য দিকে।
সামশুল চলে যাওয়ার পর এনামুল বলেন, এবার আমের ফলন খুবই কম। সিকি ভাগের (২৫ ভাগ) বেশি হবে না। দাম তো দ্বিগুণের বেশি হবেই। এমন চড়া দাম ১০-১৫ বছরের মধ্যে দেখা যায়নি। আমের এত কম ফলন, কিন্তু কানসাট বাজারে তো মোটেই তা বোঝা যায় না। উত্তরে তিনি বলেন, ‘খেতে নেই, কিন্তু খৈলানে জড়ো’ এমন কথার প্রচলন আছে এ এলাকায়। এ কথার অর্থ হচ্ছে খেতে শস্য কম থাকলেও চারদিক থেকে খৈলানে এলে তা অনেক মনে হয়। কানসাট বাজারে এলে ব্যাপারটা ঠিক তেমনটা হয়েছে।
কানসাটের মিলিকপাড়ার কয়েকজন আমচাষি বলেন, এবার শিবগঞ্জ উপজেলায় আমের ফলন ৩০ ভাগের বেশি নয়। রায়হান আলী বলেন, ‘এবারকার আমের ফলনে কেহু রাজা তো, কেহু পথের ফকির।’ সেটা কেন? এর জবাবে তিনি বলেন, এবার যাঁদের বাগানে আম ধরেছে, তাঁরা অনেক লাভ পাচ্ছেন। আর যাঁদের বাগানে আম হয়নি, তাঁদের হাতে কিছুই থাকল না।
কানসাট হাটের ব্যবস্থাপনায় যুক্ত লোকজন বলেন, আমের এই ভর মৌসুমে পুরো কানসাট ও আশপাশের এলাকাজুড়ে আমের পসরা। বেচাকেনা হচ্ছে কানসাটের চার শতাধিক আড়তে। বড় বাগানগুলোতেও চলছে বেচাকেনা। প্রতিদিন বেচাকেনা হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার। দিন দিন তা বাড়বে। বাগান থেকেও ট্রাকে ট্রাকে আম যাচ্ছে। এ হাটকে কেন্দ্র করে চাঙা হচ্ছে এলাকার অর্থনীতি।
বাজারের আম বিক্রেতারা জানান, বাজারে আমের চাহিদা আছে ভালোই। বাইরের ব্যাপারীর আনাগোনাও বেশি। ভালো দামও পাওয়া যাচ্ছে। আবার আম বিক্রির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে না। এতে তাঁরা খুশি; কিন্তু আড়তের মাধ্যমে বিক্রি করতে গিয়ে তাঁদের আম দিতে হচ্ছে ৫২ কেজিতে মণ হিসাবে। আবার যতবার দাঁড়িপাল্লায় ওঠানো হবে আম, ততবারই বড় দুটি আম সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। এতে ৫৪ কেজিতে হবে মণ। বাছাইয়ের সময়ও বাদ দেওয়া হবে কিছু। এতে বাগান থেকে আনা দেড় মণ আম বেচতে গিয়ে হয়ে যায় এক মণ। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষিরা। কয়েক বছর আগে প্রতিবাদ-আন্দোলন করতে গিয়ে উল্টো আড়তদারেরা ধর্মঘট ডেকে আম কেনা বন্ধ করে দেন। বাধ্য হয়ে আড়তদারদের শর্তেই (৫২ কেজিতে মণ) আম বিক্রি করতে হয় চাষিদের।
শিবগঞ্জের ‘ম্যাঙ্গো ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠনের সদস্যসচিব ও আমচাষি আহসান হাবিব বলেন, ‘আমরা হিসাব করে দেখেছি, ৫২-৫৪ কেজিতে মণ ধরে যে অতিরিক্ত আম নেওয়া হচ্ছে, তার দাম প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। আমরা প্রতিবাদ করে কোনো ফল পাইনি।’
এ ব্যাপারে কানসাট আমের আড়তদার সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক বলেন, অনেক বছর থেকে এমনটা চলে আসছে। তবে এবার আমচাষি ও আড়তদারদের নিয়ে একাধিক বৈঠক হয়। সমঝোতা হয় ৪৭ কেজিতে মণ ধরে বেচাবিক্রি হবে; কিন্তু আমকেন্দ্রিক একটি সংগঠনের নেতার একগুঁয়েমির কারণে তা ভেস্তে যায়। তিনি জানান, কানসাটে বেচাকেনা হয় আড়তের মাধ্যমে। প্রতিদিন লেনদেন হচ্ছে কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা। গোটা জেলায় প্রতিদিন ২৫ কোটির টাকার আম কেনাবেচা হচ্ছে। বাজারে ফজলি আমের সরবরাহ বাড়লে লেনদেনের পরিমাণ আরও বাড়বে। গোটা মৌসুমে লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়াবে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মতো। এবার ফলন অর্ধেকের কম হলেও দাম দ্বিগুণের বেশি। ফলে লেনদেনে টাকার পরিমাণ কমছে না তেমন।
এখন বাজারে ক্ষীরশাপাতি চার থেকে ছয় হাজার টাকা, ল্যাংড়া তিন থেকে সাড় চার হাজার টাকা, আম্রপালি তিন থেকে চার হাজার টাকা, ফজলি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে বলে জানান ওমর ফারুক।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপপরিচালক পলাশ সরকার বলেন, গত বছর আমের উৎপাদন হয়েছিল ৪ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। এবার তিন লাখ মেট্রিক টন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জেলায় আমবাগানের পরিমাণ ৩৭ হাজার ৬০৪ হেক্টর।
এবারে আমের কম উৎপাদনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের (আম গবেষণা কেন্দ্র) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, গত বছর পর্যাপ্ত পরিমাণ আম উৎপাদন হয়। স্বভাবতই এবার ছিল কম উৎপাদনের বছর। এবার প্রলম্বিত শীতের কারণে দেরিতে মুকুল এসেছে। বৃষ্টিতে মুকুলের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘ ও অতিরিক্ত খরায় গুটি ঝরে পড়েছে। ফলে আমের ফলনে বিপর্যয় ঘটেছে। তবে চাষিরা এবার আমের দাম ভালোই পাচ্ছে।