দবির মণ্ডল মাত্র ৪৫ দিন বয়সে মাকে হারিয়েছিলেন। বাবাকে হারান পাঁচ বছর বয়সে। ছোটবেলা থেকেই চাচা আবু বক্করের বাড়িতে গরুর রাখাল হয়ে বড় হয়েছেন। একদিন চিড়া তৈরির জন্য বাইসাইকেলে ধান নিয়ে শহরে যাওয়ার সময় ট্রাকের ধাক্কায় একটি হাত হারিয়েছেন।
এ অবস্থায় এক হাত দিয়ে রিকশা চালিয়ে জীবনধারণ করছিলেন দবির মণ্ডল। ভ্যান কিনতে ধার করা টাকাও পরিশোধ করেছিলেন। ২৫ বছর কষ্ট করে ভ্যানে একটি ইঞ্জিন লাগিয়েছিলেন। সেই ভ্যান তাঁর বাড়ি থেকে চুরি হয়ে গেছে। চোরেরা তালা ভেঙে ভ্যানটি নিয়ে গেছে। এখন তিনি কীভাবে অর্থ উপার্জন করবেন, কীভাবে সংসার চালাবেন, তা নিয়ে সারাক্ষণ কান্নাকাটি করছেন। আপাতত অন্যের ভ্যান ভাড়া নিয়ে চালাতে হচ্ছে। এতে যা আয় হচ্ছে, তা থেকে মালিকের ভাড়া দিয়ে সংসার খরচ ও ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি দিতে পারছেন না তিনি।
দবির হোসেন মণ্ডল (৫২) ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার কুলচারা গ্রামের মৃত আজগার আলী মণ্ডলের ছেলে।
দবির জানান, ছোটবেলায় মা–বাবাকে হারানোর পর চাচা আবু বক্করের বাড়িতে থাকতেন। তাঁদের বাড়ি ও মাঠে কৃষিকাজ করতেন। মাঠে গরু নিয়ে যেতেন। এভাবে প্রায় ১৭ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত থেকেছেন। এরপর একদিন তাঁদের বাড়ির চিড়া তৈরির জন্য বাইসাইকেলে ধান নিয়ে ঝিনাইদহ শহরে যাচ্ছিলেন। ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া মহাসড়কের আমতলা নামক স্থানে ট্রাকের ধাক্কায় পড়ে যান। এতে তিনি ডান হাত ও মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন। তখন চাচা ও ট্রাকমালিকের দেওয়া টাকায় তিনি চিকিৎসা নেন। তবে ডান হাতটি হারিয়ে ফেলেন। হাতে কোনো শক্তি নেই তাঁর।
চিকিৎসা থেকে ফিরে কিছুদিন চাচার বাড়ি ছিলেন। ঠিকমতো কাজ করতে না পারায় খারাপ কথা শুনতে হতো। তখন চলে আসেন ভাইট এলাকায় ভগ্নিপতি নুরুল গাজীর বাড়িতে। সেখানে ভগ্নিপতির দেওয়া ৫০০ টাকা দিয়েই তিনি প্রথমে ডিম কেনাবেচার ব্যবসা শুরু করেন। কিছুদিন এই কাজ করার পর বিয়ে করেন কুমিল্লার ফাতেমা খাতুনকে। গ্রাম থেকে ডিম কিনে বাজারে বিক্রি করে তেমন একটা লাভ হচ্ছিল না তাঁর। তখন তিনি এক হাতে ভ্যান চালানো শিখে নেন।
দবির মণ্ডল জানান, প্রায় ২৭ বছর আগে আমতলা বাজারের এক ব্যক্তির কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধারে একটি ভ্যান কেনেন। সেই ভ্যানের আয়ে তাঁর সংসার চলত। দুই বছর হলো সেই ভ্যানে ইঞ্জিন লাগিয়ে নিয়েছেন। গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে তাঁর বাড়ির উঠান থেকে ভ্যানটি চোরেরা চুরি করে নিয়ে গেছে। তালা লাগিয়ে রাখার পরও চুরি হয়েছে। এখন মাঝেমধ্যে অন্যের ভ্যান ভাড়া নিয়ে চালিয়ে সংসার বাঁচাচ্ছেন। কিন্তু কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। এনজিওর কিস্তি আর সংসার খরচ জুটছে না।
দবির মণ্ডলের মাঠে কোনো জায়গাজমি নেই। ভিটার জমিও চাচার নামে। তাঁকে কোনোমতে থাকতে দিয়েছেন বলে জানান। তিনি বলেন, তাঁর চার মেয়ে। তিনজনকে বিয়ে দিয়েছেন। এই বিয়ে দিতে গিয়ে এনজিও থেকে লক্ষাধিক টাকা ঋণ নিয়েছেন। এখন মাসে তাঁর ১৫ হাজার টাকা আয় হচ্ছে, যা থেকে পাঁচ হাজার টাকা মালিককে দিতে হচ্ছে। এরপর এনজিওর কিস্তি রয়েছে মাসে ১২ হাজার টাকা, যা আয় করতে না পেরে তিনি অত্যন্ত কষ্টে আছেন।
স্থানীয় দুধসর ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হুজুর আলী বলেন, দবির মণ্ডল খুবই অসহায় একজন মানুষ। ছোটবেলা থেকেই কষ্ট করে বড় হয়েছেন। তাঁর চলার পথে ভ্যানটিই ছিল সম্বল, সেটাও চুরি হয়ে যাওয়ায় পথে বসেছেন। তাঁরা স্থানীয়ভাবে যতটুকু পারেন, সহযোগিতা করেন। তবে একটা ভ্যান পেলে লোকটির পাশাপাশি সংসারটিও বেঁচে যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।