প্রায় ১১ বছর ধরে ‘নিখোঁজ’ আছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী। সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর) আসনের দুবারের সাবেক এই সংসদ সদস্য সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতিও ছিলেন। ‘নিখোঁজের’ পর থেকে বিএনপির অভিযোগ, সরকার তাঁকে ‘গুম’ করে রেখেছে।
এমন অবস্থায় গত রোববার ঘোষিত সিলেট জেলা বিএনপির কমিটিতে ইলিয়াস আলীকে ১ নম্বর সদস্য হিসেবে রাখা হয়। ফলে নিখোঁজ হলেও স্থানীয় রাজনীতিতে হঠাৎ যেন জোরেশোরে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছেন তিনি। দলটির তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, ইলিয়াস ‘নিখোঁজ’ হওয়ার পর দুবার জেলা বিএনপির কমিটি গঠিত হয়। প্রত্যেকবারই তাঁকে ১ নম্বর সদস্য রাখা হয়েছে। তাঁর নিখোঁজের বিষয়টি সাধারণ মানুষ এখনো সহানুভূতির চোখে দেখেন। এটি বিবেচনায় রেখেই দল ইলিয়াসকে মূল্যায়ন করেছে।
দক্ষিণ সুরমা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কোহিনুর আহমদ বলেন, ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকার বনানী থেকে ইলিয়াস আলী ‘গুম’ হন। এরপর থেকে সিলেটে সব ধরনের নির্বাচনসহ আন্দোলন-সংগ্রামে ইলিয়াস আলোচনায় ছিলেন, আছেন। দলের নেতা-কর্মীরা স্থানীয়-জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রচার-প্রচারণা এবং জেলা-উপজেলা সম্মেলনে ব্যানার-পোস্টারে ইলিয়াসের ছবি ব্যবহার করেন। এটা তাঁর প্রতি নেতা-কর্মীদের ভালোবাসা। সম্প্রতি জেলা বিএনপির ১ নম্বর সদস্য হিসেবে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করাও সে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলেন, সিলেট-২ আসনে টানা তিনবার নির্বাচন করেছিলেন এম ইলিয়াস আলী। বিএনপির ‘নিখোঁজ’ এই নেতা বিজয়ী হয়েছিলেন দুবার। ২০০১ সালের আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমান ছিলেন সিলেট বিএনপির একক নেতা। এরপর ইলিয়াস আলীর উত্থান হলে দুই ধারায় সক্রিয় ছিল সিলেট বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো। পরে ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এক সড়ক দুর্ঘটনায় সাইফুর রহমানের মৃত্যু হলে ইলিয়াস আলী সিলেট বিএনপির একক নেতায় পরিণত হন।
বিশ্বনাথ উপজেলা বিএনপির দুজন নেতা বলেন, ইলিয়াসের অনুপস্থিতিতে স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা এখনো তাঁর নামে ঐক্যবদ্ধ। তাই তাঁর ‘গুমের’ পর যে কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে, সেখানে ভোটারদের সহানুভূতি পেতে প্রার্থীরাও ইলিয়াসের নাম আলোচনায় আনেন। প্রার্থীরা এ সুবিধা ভোটের মাঠে পেয়েছেনও। ইলিয়াসের অনুপস্থিতিকে দলীয় শক্তি হিসেবেই দল কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে।
‘নিখোঁজ’ নেতাকে কমিটিতে রাখা প্রসঙ্গে জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখনো বিশ্বাস করি, ইলিয়াস আলী জীবিত আছেন। মূলত সরকার তাঁকে ‘গুম’ করে রেখেছে। এ সরকার ক্ষমতা থেকে চলে গেলে নিশ্চয়ই ইলিয়াস আলী ফিরে আসবেন। তিনি এ অঞ্চলের একজন জনপ্রিয় নেতা। তাই সব দিক বিবেচনায় তাঁকে কমিটিতে রাখা হয়েছে।’
জেলা বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, ইলিয়াস আলী নিখোঁজের পর সিলেট জেলা বিএনপির কমিটি দুবার গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ২৬ এপ্রিল কেন্দ্র থেকে ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে ইলিয়াস আলীকে ২ নম্বর সদস্য রাখা হয়েছিল। সেবার ১ নম্বর সদস্য রাখা হয়েছিল ইনাম আহমদ চৌধুরীকে। গত একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ইনাম আহমদ চৌধুরী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তাই এবার ঘোষিত কমিটিতে ইলিয়াসকে ১ নম্বর সদস্য রাখা হয়েছে।
একই সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ২৯ মার্চ সম্মেলন করে সরাসরি ভোটে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচন করেছিলেন কাউন্সিলরা। এর এক বছরের মাথায় গত রোববার ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের স্বাক্ষরে এ কমিটি অনুমোদিত হয়। কমিটিতে উপদেষ্টা হিসেবে আছেন আরও ৯১ জন।
সদ্য ঘোষিত জেলা কমিটি ঘেঁটে দেখা গেছে, জেলা বিএনপির দ্বিতীয় সদস্য হিসেবে আছেন ইলিয়াসের স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা। ১১ নম্বর সদস্য হিসেবে আছেন ইলিয়াসের ছেলে আবরার ইলিয়াস। এ ছাড়া ইলিয়াসের ভাই আছকির আলী আছেন সহসভাপতি হিসেবে আছেন। এর আগে ২৯ মার্চ অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ভোটের মাধ্যমে আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী সভাপতি, এমরান আহমদ চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক ও মো. শামীম আহমদ সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এদিকে ঘোষিত কমিটি নিয়ে দলের কিছু নেতা-কর্মীদের মধ্যে চাপা অসন্তোষ চলছে। কমিটিতে ঠাঁই পাওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, যোগ্যতা অনুযায়ী কিছু নেতা কমিটিতে যোগ্য পদ পাননি। অঙ্গসংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কয়েকজন নেতাকেও অযথাই মূল দলেও ঠাঁই দেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রবাসে থাকা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতাকেও কারণ ছাড়া কমিটিতে রাখা হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ঘোষিত কমিটি নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে কোনো দ্বিমত কিংবা রাগ-অনুরাগ নেই। ত্যাগী, পরীক্ষিত, কর্মিবান্ধব নেতারাই কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। এ নিয়ে তৃণমূলে প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। যোগ্যতা অনুযায়ীই প্রত্যেকে যথাযথ পদে এসেছেন। আর সিলেটে জেলা কিংবা মহানগরে যখনই কমিটি হয়, তখন কিছুসংখ্যক প্রবাসী নেতা ঠাঁই পান, যাঁরা দেশে রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। এমন নেতারাই কমিটিতে আছেন।