গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর তিন সাঁওতালকে হত্যার বিচারসহ সাত দফা দাবিতে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করা হয়েছে। আজ রোববার বেলা একটা থেকে ঘণ্টাব্যাপী গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা শহরের থানা মোড়ে এ কর্মসূচি পালন করে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটি। এই কমিটি আজ একই দিনে রাজশাহী বিভাগের নওগাঁয় একটি কর্মসূচি পালন করে।
আজ বেলা ১১টার দিকে দেড় শতাধিক সাঁওতাল নারী-পুরুষ গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাঁওতাল–অধ্যুষিত মাদারপুর ও জয়পুর এলাকা থেকে মিছিল বের করেন। তাঁরা তির-ধনুক নিয়ে মিছিল করে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে উপজেলা শহরে যান। এরপর মিছিলটি গোবিন্দগঞ্জ-দিনাজপুর সড়কসহ উপজেলা শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। বেলা একটা থেকে উপজেলা শহরের থানা মোড় এলাকায় ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করেন তাঁরা। এ সময় মহাসড়কের দুই পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বেলা দুইটার দিকে গোবিন্দগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বুলবুল ইসলাম ঘটনাস্থলে গিয়ে সাঁওতালদের দাবির বিষয়টি উচ্চ পর্যায়ে জানানোর আশ্বাস দিলে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।
অবরোধ চলাকালে বক্তারা সাত দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলো গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের তিন সাঁওতাল হত্যার বিচার কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি, সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ভূমি কমিশন ও পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা, সরকারি চাকরিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সরকারি কোটা নিশ্চিতকরণ, রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে সেচের পানি না পাওয়া দুই কৃষকের আত্মহত্যার প্ররোচনাকারীদের বিচার, সারা দেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর হত্যা, নির্যাতন, হয়রানি বন্ধ করা এবং তাঁদের নামে বরাদ্দ টাকা আত্মসাৎ ও ভূমি অফিসের দুর্নীতি বন্ধ করা।
অবরোধ চলাকালে বক্তব্য দেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মানিক সরেন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি রবি সরেন ও রংপুর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক যোশেফ সরেন, বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন রংপুর বিভাগের চেয়ারম্যান মার্থিয়াস মার্ডি, গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে, কোষাধ্যক্ষ প্রিসিলা মুর্মু ও সদস্য ব্রিটিশ সরেন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক রীনা মুর্মু, বাসদ দিনাজপুর জেলা শাখার আহ্বায়ক কিবরিয়া হোসেন প্রমুখ।
২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হন। পুলিশের গুলিতে শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু নামে তিনজন সাঁওতাল নিহত হন। এ ঘটনায় সাঁওতালদের পক্ষে ২৬ নভেম্বর থোমাস হেমব্রম বাদী হয়ে চিনিকলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপজেলার সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাকিল আহম্মেদসহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে অজ্ঞাতনামা দেখিয়ে মামলা করেন।
হাইকোর্টের নির্দেশে মামলাটি পিবিআই তদন্ত করে। ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) গাইবান্ধা ইউনিটের তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাঁওতাল হত্যা মামলার চূড়ান্ত অভিযোগপত্র জমা দেন। এ মামলার গুরুত্বপূর্ণ ১১ আসামির নাম বাদ দিয়ে ৯০ জনের নামে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
একই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর মামলার বাদী থোমাস হেমব্রম অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি পিটিশন দাখিল করেন। আদালত শুনানি শেষে ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক পার্থ ভদ্র অধিকতর তদন্ত করতে সিআইডিকে নির্দেশ দেন। সিআইডি ২০২০ সালের ২ নভেম্বর আদালতে একই ধরনের অভিযোগপত্র দাখিল করে। পরে বাদী থোমাস হেমব্রম ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি পুনরায় একই আদালতে নারাজি দেন।
বাদীপক্ষের আইনজীবী মো. মুরাদজ্জামান বলেন, এই নারাজির ওপর ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর শুনানি করেন আদালত। এরপর কয়েক দফায় নারাজির ওপর শুনানি হয়। সর্বশেষ গত বছরের ৪ অক্টোবর শুনানির ওপর আদেশ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেদিন আদালত কোনো আদেশ দেননি। আদালত চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি শুনানির ওপর আদেশের বিষয়ে পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন। গত ১৮ মার্চ নারাজির ওপর শুনানি হয়। শেষে আদালত ১৫ মে দিন ধার্য করেন। ওই দিন কোনো আদেশ হয়নি। আদেশ প্রদানের পরবর্তী দিন কবে ধার্য করা হয়েছে, তা জানা যায়নি।