মাত্র দেড় বছর বয়সে বাবাকে হারায় শিশু রিয়া রানী দাস (১২)। বাবার চেহারা এখন তার মনে নেই। স্কুলশিক্ষক মায়ের স্নেহ-ভালোবাসায় বাবার অভাব বুঝে উঠতে পারেনি সে। কিন্তু এক দুর্ঘটনা কেড়ে নিল মাকেও। পরিবারের সদস্য, স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী কেউই মা-বাবা হারানো শিশুটিকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না।
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের খাকটেকা গ্রামে রিয়াদের বাড়ি। রিংকু রঞ্জন দাস ও অপি রানী দেব দম্পতির একমাত্র সন্তান রিয়া রানী দাস। অপি রানী স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা করতেন। মেয়ে রিয়া এলাকার নিরোদ বিহারী উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে।
ব্যবসায়ী রিংকু রঞ্জন দাস কয়েক বছর আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আর অপি রানী ২৪ নভেম্বর সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। পরে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে তিনিও মারা যান। এতে এতিম হয়ে পড়ে তাঁর মেয়ে রিয়া রানী দাস।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে অপি রানীর (৩৫) লাশ বাড়িতে আসে। এতে স্বজনদের কান্নার রোল পড়ে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার ভয়ে সকাল থেকে রিয়াকে মায়ের মৃত্যুর খবর জানাননি স্বজনেরা। বিদ্যালয়ে মূল্যায়ন পরীক্ষা চলছে রিয়ার। রিয়া মঙ্গলবার সকালে গণিত বিষয়ের পরীক্ষায়ও অংশ নেয়। আজ বুধবার পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা। বাড়িতে লোকজনের ভিড় ও অ্যাম্বুলেন্স দেখে রিয়া ‘মা’, ‘মা’ বলে জোরে কেঁদে ওঠে। স্বজনেরাও তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। অনেকে ছুটে গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবু শিশু রিয়ার কান্না থামছে না।
স্বজনেরা জানান, ২৪ নভেম্বর অপি রানী মেয়ের জন্য জুতা কিনতে উপজেলা সদরে যাচ্ছিলেন। বাড়ির সামনের সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় উঠছিলেন অপি। চালকের তাগাদায় চলন্ত অটোরিকশায় ওঠার সময় তিনি ছিটকে সড়কের পাশে পড়ে যান। এতে মাথায় প্রচণ্ড চোট পান। প্রথমে তাঁকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। মঙ্গলবার রাতেই স্থানীয় শ্মশানঘাটে অপি রানীর মৃতদেহের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।
পাশের আমতৈল গ্রামের বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক দিবাকর দাস বলেন, ‘রিংকু রঞ্জন দাস ক্যানসারে যখন মারা যান, তখন রিয়ার বয়স ছিল দেড় বছর। রিয়ার মা অপি রানী এইচএসসি পাস ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর কিছুদিন পর সংসারের হাল ধরতে আমতৈল এলাকায় একটি কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতায় যোগ দেন। সেখানে ছুটির পর আশপাশের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে শিশুদের প্রাইভেট পড়াতেন। কিছুদিন আগে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন অপি। সামান্য বেতন ও টিউশনির টাকায় কোনোমতে সংসার চালিয়ে নিতেন। এখন তো সব শেষ হয়ে গেল। মেয়েটির কী হবে?’
রিয়ার স্বজন এক নারী বললেন, ‘অপি অল্প বয়সে স্বামী হারান। স্বজনেরা তাঁকে দ্বিতীয় বিয়ের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু রিয়ার ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। রিয়াকে আঁকড়ে ধরেই তিনি বাকি জীবন কাটিয়ে দেবেন বলতেন। সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। ছোট্ট মেয়েটা একা হয়ে গেল। কী সান্ত্বনা দেব! এ শোক সে সইবে কেমনে?’