বাংলার বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে ধ্বংসপ্রাপ্ত নানা পুরাকীর্তি। প্রাচীন সভ্যতা আর সংস্কৃতির তেমন এক বিচরণভূমি দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনপদ নওগাঁ। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে নওগাঁর প্রত্নতাত্ত্বিক ও প্রাচীন স্থাপনা ঘুরে দেখা ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে হতে পারে অনন্য অভিজ্ঞতা।
এই জেলায় আছে হাজার বছর আগের মহাবিহার (প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়) সোমপুর বিহার, জগদ্দল বিহার, অগ্রপুরী বিহার, বটগোহালী বিহার ও হলুদ বিহারের ধ্বংসস্তুপ। দেখা মিলবে বাংলায় কৈবর্ত বিদ্রোহের স্মারক দিব্য স্তম্ভ, ভীমের পান্টি, যাতে পাথরে খোদাই করা আছে হাজার বছর আগের ইতিহাসের কিছু অংশ। আরও আছে মুঘল আমলের দুর্গ শহরখ্যাত মাহীসন্তোষ। আলাউদ্দিন হোসেন শাহর আমলে নির্মিত স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নির্দশন কুসুম্বা মসজিদ। এর বাইরেও প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা সাক্ষ্য বহন করে চলেছে নাথ সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান প্রাচীন স্থাপনা যোগীঘোপা।
বাংলাদেশে ইউনেসকোর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার। এটার প্রকৃত নাম সোমপুর বিহার। জায়গাটি নওগাঁ সদর থেকে ৩৪ কিলোমিটার উত্তর দিকে বদলগাছী উপজেলায় পড়েছে। আবার জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিম দিকে এই বিহার। ধ্বংসপ্রাপ্ত এই প্রাচীন বৌদ্ধবিহারটি কালের বিবর্তনে জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় পড়ে ছিল। ১৯২৩ সালে এর খনন শুরু হয়। ১৯৩৪ সালে শেষ হয়। জানা যায়, পাল বংশের শাসনামলে দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল অষ্টম শতকে পিতৃভূমি বরেন্দ্রে এক বিশাল বৌদ্ধমন্দির স্থাপনের জন্য পাহাড়পুরে সোমপুর বিহার স্থাপন করেন। খননকালে প্রাপ্ত একটি মাটির সিল থেকে জানা যায়, এটি সোমপুর বিহার। ২৭ একর জমির ওপরে এটি স্থাপিত। এটি এশিয়ার বৃহত্তম বিহার। বৌদ্ধভিক্ষুদের বসবাসের জন্য এর চতুর্দিকে সারিবদ্ধভাবে ১৭৭টি কক্ষ ছিল।
সমগ্র বিহার প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। উত্তর দিকে প্রবেশপথ ছিল। মূল দালানে ওঠার সিঁড়িও ছিল। এটি দুর্গের মতো করে তৈরি করা হয়েছিল। এর প্রধান মন্দিরের ভিত্তিমূল–সংলগ্ন দেয়ালে ৩৬টি পাথরের মূর্তি আছে। ভেতরের মন্দিরের গায়ে পোড়ামাটির দুই হাজার চিত্রফলক আছে। খননকালে পোড়ামাটির প্রায় ৮০০ চিত্রফলক বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়।
এই বিহার জ্ঞান-বিজ্ঞান, মীমাংসা ও ধর্মশাস্ত্র চর্চার জন্য একটি উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করেছিল। পৃথিবীর নানা দেশে থেকে এখানে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানলাভের জন্য আসতেন। আচার্য অতীশ দীপঙ্কর সোমপুর বিহারে কিছুকাল বাস করেছেন। তাঁর গুরু রত্নাকর শান্তি সোমপুর বিহারের মহাস্থবির ছিলেন। এখানে আরও ছিলেন চর্যাপদের গীতিকার কাহ্নপা ও তাঁর গুরু জলন্ধরী পা ওরফে হাড়ী পা। এখানকার উদ্ধারকৃত প্রত্নবস্তু নিয়ে একটি জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে। অতিথিদের থাকার জন্য আছে বাংলো।
পাহাড়পুরের ঠিক এক কিলোমিটার আগে পড়বে আরেকটি বিহার। বদলগাছী উপজেলার বিলাসবাড়ি ইউনিয়নের দ্বীপগঞ্জ গ্রামে এটি অবস্থিত। এটি পাহাড়পুরের সমসাময়িক একটি বৌদ্ধবিহার। এটিও অন্তত হাজার বছরের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমান হলুদ বিহার তথা দ্বীপগঞ্জ গ্রাম পুরোটাই প্রাচীন জনপদের ধ্বংসাবশেষের ওপর অবস্থিত বলে অনুমান করা যায়। এই গ্রামের সবখানেই প্রাচীন ইট, নকশা করা ইট, পোড়ামাটির চিত্রফলকের টুকরা, কোনো কোনো স্থানে প্রাচীন দালানের ভিত্তিচিহ্নও চোখে পড়বে পর্যটকদের।
পাহাড়পুর বিহার থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর–পশ্চিম দিকে একটি প্রাচীন গ্রাম আছে। নাম বটগোহালী। এখানে একটি প্রাচীন জৈনবিহার ছিল। পাহাড়পুর বিহার খননকালে একটি পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। এই লিপি থেকে জানা যায়, এক ব্রাহ্মণ দম্পতি বটগোহালীতে অবস্থিত একটি জৈনবিহারের ‘অইত’ পূজা এবং একটি বিশ্রামাগারের জন্য কিছু রাষ্ট্রীয় জমি ক্রয় ও দান করা হয়েছিল। এই জৈনবিহারের প্রধান ছিলেন বিখ্যাত জৈনগুরু গুহ নন্দী এবং তাঁর বহু শিষ্য ছিলেন বলে জানা যায়। খ্রিষ্ট্রীয় পঞ্চম শতাব্দীতে জৈনবিহারটি যে একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ছিল, পাণ্ডুলিপিটি তা প্রমাণ করে।
পাহাড়পুর বিহার থেকে আরও ১৮-২০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ধামইরহাট উপজেলা। এ উপজেলায় আরও কয়েকটি প্রাচীন নির্দশন আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জগদ্দল বিহার। এটি ধামইরহাট উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। ইতিহাসবিদদের মতে, বিহারটি পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের সমসাময়িক সময়ে নির্মিত। ‘আইন-ই-আকবরী’–র রচয়িতা আবুল ফজল এ স্থানকে রমৌতি বলে উল্লেখ করেছেন। রাজা রামপাল গৌড় রাজ্য পুনরুদ্ধারের পর রামাবতী নগর করেন। সেই নগরে রাজা রামপাল জগদ্দল মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিহারে মূল মন্দির ছাড়াও ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য ৫০টি কক্ষ ছিল। পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের মতোই বিহারটি প্রাচীন বাংলার শিক্ষাদীক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল।
ধামইরহাট সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে কাশিপুর মৌজায় আগ্রাদ্বিগুণ বাজারের পশ্চিম পাশে পাহাড়ের মতো উঁচু বিরাট ঢিবি। এর ওপরের অংশ প্রায় সমতল। তিব্বতীয় সাহিত্যে এটাকে অগ্রপুরী বিহার বলা হয়েছে। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের আমলে নির্মিত এটি এককালে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ছিল।
ধামইরহাট থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দক্ষিণে পত্মীতলা উপজেলায় বাংলার নাথ সম্প্রদায়ের একটি তীর্থস্থান রয়েছে। পত্মীতলা উপজেলার আমইর ইউনিয়নে প্রাচীন ইছামতী নদীর পশ্চিম পাশে যোগীঘোপা বা যোগীগোফায় এই তীর্থস্থান। এখানে নাথ সম্প্রদায়ের কিছু প্রাচীন স্থাপনা আছে। ধারণা করা হয়, এই জায়গার কাছেই আমইর এলাকায় পাল রাজা রামপাল প্রতিষ্ঠিত রামাবতী নগরী ছিল।
নাথ সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ–পশ্চিমে পত্নীতলা উপজেলার দিবর ইউনিয়নে আছে ঐতিহাসিক দিবর দিঘি। এর মাঝখানে ৩০ ফুট উঁচু একটি স্তম্ভ আছে। এর নাম দিব্য স্তম্ভ। এটা কৈবর্ত বিদ্রোহের স্মারক। বলা হয়, এটি প্রথম সফল বাঙালি বিদ্রোহের প্রতীক। রাজা দ্বিতীয় মহিপাল ১০৭০ খ্রিষ্টাব্দে গৌড় বরেন্দ্রর সিংহাসনে বসেন বলে অনুমান করা হয়। তাঁর সময় কৈবর্ত প্রজারা বিদ্রোহ শুরু করেন। এ যুদ্ধে মহিপাল পরাজিত ও নিহত হন। কৈবর্ত প্রজাদের পক্ষে বরেন্দ্র রাজা দিব্য সিংহাসনে বসেন। দিব্য তাঁর বিজয়চিহ্ন হিসেবে দিবর নামের এক জায়গায় একটি জলাশয় খনন করেন এবং স্তম্ভ নির্মাণ করেন। আজও কালের সাক্ষী হয়ে অনেক স্মৃতি বুকে নিয়ে দিঘির মাঝখানে স্তম্ভটি দাঁড়িয়ে আছে।
ধামইরহাট উপজেলা সদর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পাল রাজা মহিপাল স্থাপিত বাংলার প্রাচীন শহর মাহীসন্তোষ। মুঘল আমলে এটি এ অঞ্চলের একটি দুর্গ শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। এরও আগে সুলতানি আমলে এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় সমমানের মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেখানে ভারতবর্ষসহ মধ্যপ্রাচ্যের ছাত্ররাও এসে অধ্যয়ন করেছেন। এখানে আছে বখতিয়ার খলজির অন্যতম সেনাপতি শিরন খলজির মাজার। শহরটি বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত। মাটি খুঁড়লে প্রাচীন আমলের প্রচুর ইট–পাথর পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজন সেগুলো তুলে বাড়িঘর বানিয়েছেন।
নওগাঁ শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার পশ্চিমে এবং মান্দা উপজেলার সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার পশ্চিমে রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের পাশে কুসুম্বা গ্রামে অবস্থিত কুসুম্বা মসজিদ। পাথরের তৈরি এই মসজিদের দেয়ালজুড়ে আছে প্রাচীন টেরাকোটার কাজ। আছে জ্যামিতিক নকশার আদলে পোড়ামাটির সুদৃশ্য কারুকাজ। মিহরাবে বিচিত্র ফুল, লতাপাতা, ঝুলন্ত শিকল ও মনোরম শিল্পকর্ম। প্রায় ৪৬৪ বছরের পুরোনো এই মসজিদ স্থাপত্য নান্দনিকতায় আজও মুগ্ধতা ছড়ায়।
প্রাচীন পুরাকীর্তি ছাড়াও এখানে আছে বলিহার রাজবাড়ি, দুবলহাটি রাজবাড়ি ও পতিসরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারিবাড়ি। বলিহার রাজবাড়ি নওগাঁ শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়ক–সংলগ্ন বলিহার গ্রামে অবস্থিত। দুবলহাটি রাজবাড়ি নওগাঁ শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটর উত্তরে দুবলহাটি বাজার এলাকায় অবস্থিত। পতিসর রবীন্দ্রকুঠিবাড়ি নওগাঁ শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটর উত্তর-পূর্বে আত্রাই উপজেলার পতিসর এলাকায় নাগর নদের তীরে অবস্থিত।
ধান, চাল ও আম উৎপাদনে প্রসিদ্ধ নওগাঁয় বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠ আর বিশাল বিশাল আমবাগানের সৌন্দর্য মুগ্ধ করে পর্যটকদের। জবই বিল, ধামইরহাটের আলতাদিঘি জাতীয় উদ্যান, রানীনগরের রক্তদহ বিল ও নওগাঁ সদর উপজেলার হাঁসাইগাড়ি বিলের অপরূপ সৌন্দর্য তো আছেই। শীতকালে এসব জলাশয়ে দেখা মেলে পরিযায়ী পাখির।