দুরন্ত এক তরুণের নাম সাইফুল ইসলাম সাকিব (১৮)। ২০২২ সালে তিনি এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর কলেজে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর। হঠাৎ মায়ের মৃত্যুতে সেই স্বপ্ন ভেঙে যায় তাঁর। এবার বন্যার পানিতে ডুবে জীবনটাই থেমে গেল সাইফুলের।
গত মঙ্গলবার দুপুরে বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে শাহ আলম খানের ঘাটা এলাকার পশ্চিম পাশে নবনির্মিত দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনের পাশে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে বন্যার পানিতে ডুবে নিখোঁজ হন সাইফুল ইসলাম। নিখোঁজের দুই দিন পর গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাতটায় তাঁর লাশ উদ্ধার করেছেন স্বজনেরা।
সাইফুল ইসলাম চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের জলিল নগর নজুমিয়া পাড়া এলাকার বাসিন্দা সমশুল ইসলামের বড় ছেলে। গত বছর আমিরাবাদ জনকল্যাণ উচ্চবিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেন। তাঁর একমাত্র ছোট ভাই সাজিব মাহমুদ (৮) স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্র।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে আমিরাবাদ জলিল নগর এলাকায় সাইফুলদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সুনসান নীরবতা। বাড়ির উঠানে খেলতে থাকা সাইফুলের ছোট ভাই সাজিব এ নীরবতার মানে বোঝে না। সেখানে আলাপকালে প্রতিবেশী আবদুস সাত্তার বলেন, ‘খুবই ভালো ছেলে ছিল সাকিব। এলাকার সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল তার। সব বয়সী মানুষ তাকে ভালোবাসত।’
স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাইফুলের বাবা সমশুল ইসলাম দীর্ঘ ১৭ বছর প্রবাসে ছিলেন। ছয় মাস আগে কাজ হারিয়ে দেশে ফেরেন। দেশে এসে রোগে আক্রান্ত হন। এখনো কোনো আয়ের উৎস নেই, নেই সঞ্চয়। বাবা প্রবাসে থাকায় স্নেহ-মমতায় বড় করেছেন তাঁর মা খানম আক্তার। তিনি সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন। গত বছর পয়লা রমজানে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা যান খানম আক্তার। মায়ের মৃত্যুর শোকে দিশেহারা হয়ে পড়েন সাইফুল। এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন থাকলেও মায়ের মৃত্যুতে সেই স্বপ্ন থেমে যায়।
সাইফুলদের বাড়িতে কথা হয় তাঁর মামা নাছির উদ্দিনের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সাইফুলের প্রবাসী বাবা এখন কর্মহীন ও অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে আছেন। তাই পরিবারে আর্থিক সহযোগিতা করতে ১২ দিন আগে উপজেলার আমিরাবাদ স্টেশনে একটি ওষুধের ফার্মেসিতে কাজ শুরু করেছিলেন সাইফুল।
সাইফুলের দুই বন্ধু শাহেদুল আলম ও আবু সাঈদ জানান, গত মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে তাঁরা তিন বন্ধু মিলে ঘুরতে বের হয়েছিলেন। তাঁরা প্রথমে বাড়ির পশ্চিম পাশে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে ওঠেন। রেললাইন ধরে দক্ষিণে হাঁটতে হাঁটতে দুপুর সাড়ে ১২টায় শাহ আলম খানের ঘাটা এলাকায় পৌঁছান। ওই এলাকায় একটি গ্রামীণ সড়কের জন্য রেললাইনের নিচে একটি আন্ডার পাস (ছোট কালভার্ট) ছিল। তখন ওই আন্ডার পাস দিয়ে পানি তীব্র গতিতে প্রবাহিত হচ্ছিল। রেললাইনের পূর্ব পাশের গ্রামীণ সড়কটিতে সাঁতরে ওঠার জন্য চারজন পানিতে ঝাঁপ দেন। এর মধ্যে তাঁদের এক বন্ধু সাঁতরে নিরাপদে সড়কে পৌঁছান। সাইফুলসহ তাঁরা তিনজন স্রোতের তোড়ে তলিয়ে যেতে থাকেন। এ সময় তাঁদের চিৎকারে স্থানী লোকজন এগিয়ে এসে দুজনকে উদ্ধার করেন। এ সময় সাইফুল পানিতে তলিয়ে নিখোঁজ হন। পরে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়।
লোহাগাড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, নিখোঁজের পর স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি গত বুধবার সকালে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তিন ঘণ্টা অভিযান চালিয়েও সন্ধান পাননি। পরে সাইফুলের লাশ উদ্ধার করেন স্থানীয় লোকজন। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাশ দাফন-কাফনের জন্য পরিবারের কাছে আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে সাইফুলকে দাফন করা হয়েছে। সেখানে দুপুরে কবরের পাশে মুঠোফোনে ছেলের ছবি দেখে থেমে থেমে বিলাপ করছিলেন বাবা সমশুল ইসলাম।