১২ বছর আগে ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার মিদ্দার হাটের কামাল উদ্দিন ও বিবি কুলসুমের সংসারে জন্ম নেয় ফুটফুটে এক শিশু। নাম রাখা হয় আবদুল্লাহ আল মুনায়েম। সংসারে প্রথম সন্তান জন্মের খবরে কামাল আর কুলসুমের পরিবারে আনন্দের সীমা ছিল না। তবে আবদুল্লাহর জন্মের পরমুহূর্তে সেই আনন্দ ম্লান হয়ে গিয়েছিল। কারণ, জন্মের পর দেখা গেল, আবদুল্লাহর দুটি হাত নেই।
প্রতিবন্ধী সন্তান জন্মের পর প্রতিবেশীদের নানা কটু কথা শুনতে হয়েছে কামাল আর কুলসুমকে। অভাবের সংসারে ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে সব সময়ই দুশ্চিন্তায় থাকতেন আবদুল্লাহর মা–বাবা। তবে ছোটবেলা থেকেই কুলসুমের সংকল্প ছিল তাঁর ছেলে যেন কারও ওপর নির্ভরশীল না হয়। এ জন্য আবদুল্লাহকে পা দিয়ে সব কাজ করা শিখিয়েছেন তিনি। পা দিয়েই লিখতে পারে আবদুল্লাহ। শুধু লেখা নয়, পায়ের আঙুলের ফাঁকে রংপেনসিল ধরে আবদুল্লাহ ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলে চমৎকার সব চিত্রকর্ম।
গত ঈদুল ফিতরে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ঈদের শুভেচ্ছা কার্ডে স্থান পেয়েছে আবদুল্লাহর আঁকা ছবি। বঙ্গবন্ধু ও গ্রামবাংলাকে নিয়ে আঁকা ছবিটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরেও আসে। এরপর ফেনী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে আবদুল্লাহর পরিবারের অসচ্ছলতার বিষয়টি জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে উপহারস্বরূপ নগদ এক লাখ টাকা পুরস্কার ও আড়াই শতাংশ জমির ওপর একটি আধা পাকা টিনশেড বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার দাগনভূঞা পৌরসভার উদরাজপুর এলাকায় ওই বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।
তবে আবদুল্লাহর এই সাফল্য তার বাবা কামাল উদ্দিন দেখতে পারলেন না। তিন বছর আগে সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে ওমানে পাড়ি জমিয়েছিলেন কামাল। তবে ভাগ্য মুখ তুলে তাকায়নি। বছর দুয়েক আগে ওমানেই সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। স্বামীকে হারানোর পর কুলসুমের কাঁধে পুরো সংসারের দায়িত্ব। আবদুল্লাহ বর্তমানে দাগনভূঞা একাডেমিতে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। আবদুল্লাহর ছোট ভাই একই বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণিতে পড়াশোনা করে।
বর্তমানে দুই ছেলেকে নিয়ে কুলসুম দাগনভূঞা শহরে একটি ভাড়ার বাসায় থাকেন। কুলসুম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এতদিন আমার ভাই ও অন্যান্য স্বজন ছেলেদের পড়াশোনার খরচ দিতেন। অনেক কষ্টে ছেলেদের পড়াশোনা করাচ্ছি। এর মধ্যে আবদুল্লাহ প্রতিবন্ধী হওয়ায় অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে। তবে আমি ছেলেকে সব কাজ করতে শিখিয়েছি। শত কষ্ট হলেও ওর পড়াশোনা বন্ধ করিনি। এখন এই ছেলেই আমাদের গর্বিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের দিকে হাত বাড়িয়েছেন। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমরা চিরকৃতজ্ঞ।’
গতকাল মঙ্গলবার দাগনভূঞা পৌরসভার উদরাজপুর এলাকায় ওই বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর কাজের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ উল হাসান। অনুষ্ঠানে আবদুল্লাহর পরিবারের জন্য কেনা জমির মূল্য বাবদ জমির মালিককে ৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকার একটি চেক হস্তান্তর করা হয়।
অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক বলেন, জন্মগতভাবে শিশুটির দুই হাত নেই। তবুও সে নিজেকে একজন যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলছে। প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সে পা দিয়ে ছবি এঁকে উপজেলা ও জেলায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। তার আঁকা ছবি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হয়েছে। তাঁর নির্দেশেই জমিসহ পাকা ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে।
এর আগে আবদুল্লাহর পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছে সালেহ উদ্দিন চৌধুরী ও হোসনে আরা চৌধুরী ফাউন্ডেশন। যত দিন সে পড়াশোনা করবে, তত দিন লেখাপড়ার খরচ দেবে ওই প্রতিষ্ঠান।
আবদুল্লাহর ছবি আঁকা শেখার পেছনে ভূমিকা রেখেছেন স্থানীয় স্কুলশিক্ষক গিয়াস উদ্দিন। তিনি বিনা মূল্যে আবদুল্লাহকে ছবি আঁকা শেখান। গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘কোনো কিছুই আবদুল্লাহকে থামাতে পারেনি। সে আসলেই অদম্য। এ জন্য আমি তার কাছ থেকে টাকা নিই না। আবদুল্লাহর ছবিতে গ্রামবাংলা, প্রকৃতি ও আশপাশের মানুষের গল্প ফুটে ওঠে। রাষ্ট্রও আবদুল্লাহর প্রতিভার স্বীকৃতি দিয়েছে। এটা সবার জন্যই আনন্দের খবর।
প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতি পেয়ে দারুণ খুশি আবদুল্লাহ। নতুন করে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখছে সে। আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলে, আপাতত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। পড়াশোনা শেষে যা–ই করি না কেন, ভালো মানুষ হতে চাই। আর ছবি আঁকতে আমার ভালো লাগে। সেটিও চালিয়ে যাব।’