গাছের ডালে পাশাপাশি বসে আছে বক ও পানকৌড়ি। সম্প্রতি পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার হোগলাবুনিয়া গ্রামের গাজীবাড়িতে
গাছের ডালে পাশাপাশি বসে আছে বক ও পানকৌড়ি। সম্প্রতি পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার হোগলাবুনিয়া গ্রামের গাজীবাড়িতে

পিরোজপুরের যে বাড়িতে বক ও পানকৌড়ির মিলেমিশে বসবাস

সড়কের পাশে অবস্থিত গাজীবাড়ি। বাড়িটির আঙিনা ও চারপাশ গাছগাছালিতে ঠাসা। ২০০০ সালের এক বিকেলে প্রথম একঝাঁক সাদা বক এসব গাছে এসে বসতি গড়ে। তখন বকের সঙ্গে আসে কিছু পানকৌড়িও। প্রায় দুই যুগ ধরে এসব গাছে মিলেমিশে বসবাস করছে বক ও পানকৌড়ি। প্রতিবছর প্রজনন মৌসুমে বক ও পানকৌড়ি দল বেঁধে বাড়িটিতে আসে। এরপর দুই দফা ডিম পেড়ে বাচ্চা ফুটিয়ে চলে যায়।

বছরের ছয় থেকে সাত মাস গাজীবাড়ি ও এর আশপাশ এলাকা শত শত পাখির কলতানে মুখরিত থাকে। এ সময় বিভিন্ন এলাকা থেকে পাখিপ্রেমীরা বাড়িটিতে পাখি দেখতে যান। স্থানীয় মানুষের কাছে বাড়িটি ‘পাখিবাড়ি’ হিসেবে পরিচিতি। পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার হোগলাবুনিয়া গ্রামে গাজীবাড়ি অবস্থিত। গাজীবাড়ির পাশে অবস্থিত কাজীবাড়ি ও সিকদারবাড়ির বড় গাছগুলোতেও রয়েছে কয়েক শ পাখির বাসা।

গাছে যেন সদা বকের মেলা বসেছে। সম্প্রতি পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার হোগলাবুনিয়া গ্রামের গাজীবাড়িতে

সম্প্রতি সরেজমিন পিরোজপুর-পাড়েরহাট সড়কের পাশে গাজীবাড়ি ও কাজীবাড়ির তেঁতুল, নারকেল, চাম্বল, গাব, আম, সুপারি ও বরইগাছে অসংখ্য পাখি বাসা দেখা গেছে। বাসায় বসে পাখির ডিমে তা দিতেও চোখে পড়ে। গাছে গাছে বসে আছে সাদা বক আর পানকৌড়ি। কোনো কোনো পাখি ওড়াউড়িও করছে। মা পাখি খাবার নিয়ে এসে ছানাদের খাওয়াচ্ছে। বড় গাছের মগডালে ধবধবে সাদা বক দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য পথচারীদের নজর কাড়ে।

গাজীবাড়ির বাসিন্দা ৫০ বছর বয়সী মোস্তফা গাজী। তিনি বলেন, ‘প্রায় দুই যুগ আগে বক ও পানকৌড়ি আমাদের বাড়িতে এসে গাছে বসবাস শুরু করে। সেই থেকে আমাদের বাড়িতে প্রতিবছর পাখি আসে। আমরা পাখিদের কোনো হয়রানি করি না। পাখিরা নিরাপদে আমাদের বাড়িতে বসবাস করছে।’

আমার বাবা মারা যাওয়ার আগে বলে গেছেন পাখিদের প্রতি খেয়াল রাখতে। বাবার কথা রাখতে গিয়ে পাখিদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছি।
মোস্তফা গাজী, পাখি বাড়ির বাসিন্দা
উঁকি দিয়ে কী যেন দেখছে সাদ বকটি। সম্প্রতি পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার হোগলাবুনিয়া গ্রামের গাজীবাড়িতে

মোস্তফা গাজী আরও বলেন, ‘আমার বাবা মারা যাওয়ার আগে বলে গেছেন পাখিদের প্রতি খেয়াল রাখতে। বাবার কথা রাখতে গিয়ে পাখিদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছি। এত বছর ধরে আমাদের বাড়িতে আসায় পাখিদের প্রতি মায়া হয়ে গেছে। শুরুতে শুধু আমাদের বাড়িতে পাখিরা গাছে বাসা তৈরি করত। কয়েক বছর ধরে পাখির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আমাদের পাশের বাড়ির গাছেও তারা বাসা তৈরি করছে।’

শিকারিদের হাত থেকে পাখি ও তার ছানাদের রক্ষার জন্য স্থানীয় মানুষ সব সময় সতর্ক থাকেন বলে জানান হোগলাবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা বেল্লাল কাজী। তিনি বলেন, ঝড়বৃষ্টিতে অনেক সময়ে গাছ থেকে পাখির ছানা মাটিতে পড়ে। কিছু ছানা মাটিতে পড়ে মারাও যায়। বেঁচে যাওয়া ছানা মানুষ কুড়িয়ে নিয়ে যায়। তবে গাছ থেকে কখনো পাখির ছানা নামানো হয় না।

প্রতিবছর চৈত্র মাসে বক ও পানকৌড়ি পাখি বাড়িতে আসে। কিছুদিন পর গাছের ডালে বাসা তৈরি করে। বৈশাখ-জ্যেষ্ঠ মাসে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে। বাচ্চা ফোটার পর বড় হয়ে উড়তে শিখলে পাখিরা বাসা ভেঙে ফেলে।
সাদা বক ও পানকৌড়ির নিরাপদ আশ্রয়। সম্প্রতি পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার হোগলাবুনিয়া গ্রামের গাজীবাড়িতে

পাখিদের নিয়ে গল্প হয় মোস্তফা গাজীর সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রতিবছর চৈত্র মাসে বক ও পানকৌড়ি তাঁদের বাড়িতে আসে। কিছুদিন পর গাছের ডালে বাসা তৈরি করে। বৈশাখ-জ্যেষ্ঠ মাসে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে। বাচ্চা ফোটার পর বড় হয়ে উড়তে শিখলে পাখিরা বাসা ভেঙে ফেলে। এরপর শ্রাবণ মাসে আবার নতুন করে বাসা তৈরি করে দ্বিতীয় দফায় ডিম পাড়ে। বাচ্চা ফোটার পর বড় হলে আশ্বিন-কার্তিক মাসে পাখিরা চলে যায়। প্রথম দফায় ডিম থেকে ফোটা ছানারা ওড়া শেখার পর থেকে যায়। বর্ষা মৌসুম শেষে সব পাখি একসঙ্গে চলে যায়।

গাজীবাড়ির গাছে পাখির ছড়াছড়ি। সম্প্রতি পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার হোগলাবুনিয়া গ্রামে

হোগলাবুনিয়া গ্রামের তরুণ সুরাজ মাহামুদ (১৯)। তিনি খুলনা বিএল কলেজের সম্মান প্রথম বর্ষের ছাত্র। গাজীবাড়ি ঘিরে যে পাখির অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে, এতে বেশ খুশি। তিনি বলেন, গাজীবাড়িতে পাখি দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে পাখিপ্রেমীরা আসেন। কয়েক বছর আগে কিছু মানুষ পাখি শিকার শুরু করেছিলেন। তখন পাখি আসা কমে গিয়েছিল। এরপর এলাকাবাসী শিকারিদের তাড়িয়ে দিলে পাখির সংখ্যা বেড়ে যায়। পাখিরা বসবাসের জন্য স্থানটিকে নিরাপদ মনে করছে। পাখি দেখতে আসা দর্শনার্থীদের দেখে পাখিরা উড়ে যায় না। এতে দর্শনার্থীরাও মন ভরে পাখি দেখেন।