সংঘর্ষের সময় গত বৃহস্পতিবার আগুন দেওয়া হয় অটোরিকশাটিতে। গতকাল বেলা একটায় খাগড়াছড়ির দীঘিনালার লারমা স্কয়ারে
সংঘর্ষের সময় গত বৃহস্পতিবার আগুন দেওয়া হয় অটোরিকশাটিতে। গতকাল বেলা একটায় খাগড়াছড়ির দীঘিনালার লারমা স্কয়ারে

লারমা স্কয়ারজুড়ে পোড়াচিহ্ন

  • ৮৬টি দোকান পুড়েছে। এর মধ্যে ৫৫টি পাহাড়িদের; বাকিগুলো বাঙালিদের। এর বাইরে ২৬টি দোকান ভাঙচুর করা হয়।

  • শুধু আগুন দেওয়া নয়, লুটপাটও হয়েছে। স্টুডিও অনুকা থেকে তালা ভেঙে ভিডিও ক্যামেরা, ডিজিটাল ক্যামেরা, আইপিএস ও কম্পিউটার–মনিটর নিয়ে গেছে।

গাছের কচি পাতাগুলো ঝলসে বিবর্ণ হয়ে গেছে। কাছাকাছি যেতেই গাছপালার নিচের দৃশ্য চোখে পড়ল। সেখানে পোড়া ছাই আর লোহালক্কড়ের কিছু ‘কঙ্কাল’। সব পুড়ে ছারখার। একপাশে দাঁড়িয়ে শূন্য ভিটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন সমর বিকাশ চাকমা।

এটি খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা সদরের লারমা স্কয়ার বাজারের চিত্র। ১৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে সহিংসতার আগুনে পুড়েছে বাজারটি। পাহাড়িদের দোকান বেশি পুড়েছে, বাদ যায়নি বাঙালিদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও।

৭২ ঘণ্টা অবরোধের পর গতকাল মঙ্গলবার থেকে খাগড়াছড়িতে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। দীঘিনালাসহ বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি দেখা গেছে। তবে এর মধ্যে গতকাল দীঘিনালার বোয়ালখালী মাছবাজার এলাকায় সাজেক থেকে ফেরার পথে তিন পর্যটককে অপহরণচেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনার পর সাজেকে আগামী তিন দিন পর্যটকদের যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।

১৮ সেপ্টেম্বর মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মো. মামুন নামের এক বাঙালি যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। পরদিন দীঘিনালায় পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে সহিংসতা হয়। ওই দিন দীঘিনালায় পিটুনিতে ধনঞ্জয় চাকমা নামে এক ব্যক্তি মারা যান। রাতে সদরে গোলাগুলি হয়। এ সময় দুজন পাহাড়ি যুবক মারা যান।

২০ সেপ্টেম্বর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক প্রেসনোটে বলা হয়, ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ি জোনের একটি টহল দল একজন মুমূর্ষু রোগীকে স্থানান্তরের সময় শহরের স্বনির্ভর এলাকায় পৌঁছালে ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীরা গুলি চালান। আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালান। গোলাগুলিতে তিনজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হন।

গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, দোকানিরা তাঁদের পোড়া ভিটায় ফিরছেন। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন। দীঘিনালা উপজেলা প্রশাসনের হিসাবে ৮৬টি দোকান পুড়েছে। এর মধ্যে ৫৫টি পাহাড়িদের; বাকিগুলো বাঙালিদের। এর বাইরে ২৬টি দোকান ভাঙচুর করা হয়।

দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মামুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে লারমা স্কয়ারে আগুন দেওয়া হয়। আগুনে শতাধিক ভাসমান দোকান পুড়ে যায়। এর বাইরে ৮৬টি স্থায়ী দোকান পুড়ে যায়। এখন পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত। দোকানিদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।

সমর বিকাশ তাঁর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ‘পাহাড়িরা উপজেলা পরিষদের দিকে ছিলেন। বাঙালি ও সেনাসদস্যরা ছিলেন লারমা স্কয়ারের দিকে। পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলতে থাকে। একপর্যায়ে আগুন দেওয়া হয় আমার দোকানের পাশ থেকে। কোনোরকমে স্ত্রীসহ বের হয়ে আসি। সব পুড়ে ছাই। আমার চার লাখ টাকা ঋণ আছে।’

লারমা স্কয়ারের রাস্তার দুই পাশের দোকানই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে ১০০ গজ দূরে ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন; কিন্তু ফায়ার সার্ভিসকেও আগুন নেভাতে দেওয়া হয়নি। টাকার অঙ্কে এই ক্ষতি ছয় কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে জানান ইউএনও মামুনুর রশীদ।

দিদারুল আলমের হার্ডওয়্যারের দোকান এবং আকতার হোসেনের সার, বীজ ও কীটনাশকের দোকানও পুড়ে গেছে। আকতারের ১৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান। দিদারুল আলম বলেন, ‘আমার দোকান বন্ধ ছিল। আমি যাচ্ছিলাম খাগড়াছড়ি সদরের দিকে। পথে ফোনে জানানো হয়, দোকানে আগুন দেওয়া হয়েছে। সব শেষ হয়ে গেছে। ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে আমার।’

লারমা স্কয়ারের কিছু দোকান গত ৩ এপ্রিল বৈদ্যুতিক গোলযোগে আগুন লেগে পুড়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে ছিল দীপন চাকমার রেস্তোরাঁটিও। এরপর তিনি কাঠের কাঠামোর ওপর দোতলা একটি রেঁস্তোরা ও আবাসিক হোটেল দাঁড় করিয়েছিলেন। দোকানের পাশাপাশি তাঁর নিজস্ব অটোরিকশাটিও পুড়ে যায়। সেই সঙ্গে পুড়েছে দোকানের নিচে থাকা সাতটি মোটরসাইকেল।

দীপন চাকমা বলেন, ‘মিছিলের এক পর্যায়ে মাইকে ঘোষণা আসে, আক্রমণ হচ্ছে। তখন বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন বের হয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। মিছিল চলাকালে দোকানের শাটার বন্ধ করে ভেতরে ছিলাম। আগুন দেওয়ার পর বের হয়ে আসি। মারধর করা হয় তখন।’

শুধু আগুন দেওয়া নয়, লুটপাটও হয়েছে। স্টুডিও অনুকা থেকে তালা ভেঙে ভিডিও ক্যামেরা, ডিজিটাল ক্যামেরা, আইপিএস ও কম্পিউটার–মনিটর নিয়ে গেছে। তার পাশে নিউক্রয় চাকমার চায়ের দোকানটির আসবাব বলতে কিছু নেই।

হাহাকার চলছে দীঘিনালা উদোলবাগান এলাকার ধনঞ্জয় চাকমার বাড়িতে। একটি বেড়ার ঘরে তাঁদের বসবাস। বাড়ির সামনে যেতেই দেখা গেল, ছোট ছেলে দীপন চাকমাকে। দীপন বলেন, বাবা সেদিন মাইনি ব্রিজের ওখানে ছিলেন। সেখানেই তাঁকে মারধর করা হয়। গাড়িতে তুলে কিছুদূর নিয়ে যাওয়া হয়। পরে গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান তিনি।

পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে উল্লেখ করে খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল প্রথম আলোকে বলেন, দোকানপাট খুলেছে। মানুষের আনাগোনাও বেড়েছে।