ঘরের খুঁটিতে হেলান দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন গৃহবধূ সুক্ক বৈরাগী। শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার সেনদিয়া এলাকায়
ঘরের খুঁটিতে হেলান দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন গৃহবধূ সুক্ক বৈরাগী। শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার সেনদিয়া এলাকায়

‘আমার পোলাডাও গেল, লক্ষ লক্ষ ট্যাকাও জলে গেল’

ঘরের দরজার পাশে গৃহবধূ সুক্ক বৈরাগী খুঁটিতে হেলান দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘আমার পোলাডা কেন যে বিদ্যাশে গেল। দ্যাশেই খেতখামারে কাম কইরা আমরা ভালো ছিলাম। এখন আমার পোলাডাও গেল, লক্ষ লক্ষ ট্যাকাও জলে গেল।’ আজ শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার সেনদিয়া গ্রামে ছেলে সজল বৈরাগীর (২২) লাশের অপেক্ষায় থাকা মা সুক্ক বৈরাগী এভাবেই আহাজারি করছিলেন।

সম্প্রতি তিউনিসিয়ায় ভূমধ্যসাগরে নৌকায় দালালদের নির্যাতনে আট বাংলাদেশি মারা গেছেন। সজল বৈরাগী ওই আট বাংলাদেশির মধ্যে একজন। আটজনের মধ্যে পাঁচজনই মাদারীপুরের রাজৈরের বাসিন্দা। বাকি তিনজনের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে।

সজল বৈরাগী রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রামের সুনীল বৈরাগী ও সুক্ক বৈরাগী দম্পতির বড় ছেলে। এই দম্পতির ছোট ছেলের নাম সজীব বৈরাগী।

স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে সজল নিজেদের কৃষিজমিতে তাঁর বাবার সঙ্গে কাজ করতেন। সজীব স্থানীয় একটি সোনার দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন।

সজীব বৈরাগী প্রথম আলোকে বলেন, জমি, গরু বিক্রি করে ও মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ১৪ লাখ টাকা দালাল মোশারফকে দিয়েছেন। এত টাকা দেওয়ার পরও ভাই মারা গেলেন। এখন দালাল মামলা করতে না করছেন। কিছু টাকা ফেরত দেবেন বলে বলেছেন, কিন্তু দিচ্ছেন না। তাঁরা গরিব মানুষ, মামলা করতে গেলে টাকাপয়সার ব্যাপার। ভাইকে তো আর ফেরত পাবেন না। তাই দালালের সঙ্গে আপস করার চেষ্টা করছেন।

সজলের ভাগনে নয়ন বাড়ৈ বলেন, তাঁর মামার লাশ বাড়ির সামনে কবর দেওয়া হবে। এ জন্য কবর খুঁড়েছেন। তাঁর মামার এভাবে মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মানব পাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের সুন্দরদী গ্রামের মোশারফ কাজী। তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করেন পার্শ্ববর্তী গজারিয়া গ্রামে রহিম শেখ। তাঁরা আশপাশের গ্রামে তরুণদের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশের পাঠানোর নামে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। এ বিষয়ে জানতে মোশারফের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি ধরেননি।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে সৌদিয়া এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটজনের লাশ এসে পৌঁছায়। তখন লাশগুলো নিতে ভিড় করেন স্বজনেরা। কিন্তু ময়নাতদন্তের জন্য লাশগুলো পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। আজ শুক্রবার লাশ ময়নাতদন্তের পর পরিবারের কাছে হস্তান্তরের কথা আছে।

স্বজন, পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৪ জানুয়ারি মাদারীপুরের রাজৈর ও গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার কয়েক যুবক ইতালির উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন। প্রথমে তাঁরা দুবাই হয়ে উড়োজাহাজে করে লিবিয়ায় পৌঁছান। পরে ১৪ ফেব্রুয়ারি লিবিয়া থেকে দালালদের মাধ্যমে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ইতালির উদ্দেশে রওনা হন তাঁরা। মাঝপথে তিউনিসিয়ায় ভূমধ্যসাগরে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে যাওয়া পথে তাঁদের নির্যাতন করা হয়। এতে রাজৈরের কোদালিয়ার সজীব কাজী, পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামে মামুন শেখ, সেনদিয়ার সজল বৈরাগী, কদমবাড়ির নয়ন বিশ্বাস, কেশরদিয়া গ্রামের কাওসার, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের রিফাদ, রাসেল ও আপনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া এক পাকিস্তানি নাগরিকও মারা যান। খবর পেয়ে কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করে স্থানীয় কোস্টগার্ড।

নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা গতকাল ঢাকার বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, ৩০ জন যেতে পারবেন, এমন একটি ছোট নৌকায় ৫২ জনকে নিয়েছিলেন দালালেরা। যে আটজন মারা গেছেন, তাঁদের নৌকার পাটাতনের নিচে জোর করে রাখা হয়েছিল। তাঁরা অক্সিজেন-সংকটের কারণে পাটাতন থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু দালালেরা তাঁদের মারধর করে আবার সেখানে পাঠান। এভাবে নির্যাতন ও অক্সিজেন-সংকটের কারণেই তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা মামলা করলে সব ধরনের আইনি সহযোগিতা করা হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে। তবে ভুক্তভোগীরা মামলা করতে আগ্রহী কম।