কিশোরগঞ্জের নিকলী

তালপাতার হাতপাখায় ঘোরে সংসারের চাকা 

হাতপাখা তৈরিতে ব্যস্ত কারিগরেরা। গত শনিবার কিশোরগঞ্জের নিকলীর দামপাড়া ইউনিয়নের বর্মন পাড়া এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

৮০ বছরের ভানুমতী সূত্রধর এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। তারপরও তাঁর হাত চলছে। এ বয়সেও প্রতিদিন তালপাতা দিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি হাতপাখা তৈরি করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর স্বামী শিরীষ সূত্রধরকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। এরপর জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে প্রায় ৫০ বছর ধরে হাতপাখা তৈরি করছেন তিনি। 

শুধু ভানুমতী নন, কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত হাওরাঞ্চল নিকলীর উপজেলার দামপাড়া ইউনিয়নের বর্মনপাড়া গ্রামের অনেকের সংসার চলে এ হাতপাখা বিক্রি করে। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে পাখা তৈরির খ্যাতির কারণে এই গ্রামকে অনেকেই ‘তালপাখার গ্রাম’ বলে চেনেন। 

এলাকার লোকজন বলেন, গ্রামের ২০০ পরিবারের লোকজন তালপাতার হাতপাখা তৈরির কাজে জড়িত। এখানকার কেউ পাখার কারিগর, আবার কেউ ব্যবসায়ী। সারা বছর অন্য কাজ করলেও চৈত্র মাস আসার আগে থেকেই এ গ্রামের দৃশ্যপট যেন বদলে যায়। সব বাড়িতে দেখা যায় একই দৃশ্য। ঘর ও উঠানে বসে হাতপাখার কাজে ব্যস্ত সবাই। 

সম্প্রতি ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নারী ও শিশুরা ভীষণ ব্যস্ত। ঘরের আঙিনায় বসে সবাই তৈরি করছেন হাতপাখা। কেউ তালপাতা চিরিয়ে নিচ্ছেন, কেউ হাতপাখা তৈরি করছেন, আবার কেউ তৈরি করা হাতপাখায় বেত দিয়ে চাকা বাঁধছেন। আবার কেউ তালপাতায় রং মাখাচ্ছেন। একেকজন একেক কাজে ব্যস্ত। কিছু কিছু পরিবারের পুরুষেরা তাঁদের কাজে সহযোগিতা করছেন। 

আকলিমা আক্তার বলেন, তাঁর স্বামী মারা গেছেন। এখন তিনি দুই মেয়ে, এক ছেলে নিয়ে হাতপাখা তৈরি করে সংসার চালাচ্ছেন। তবে এখন সবকিছুর দাম বাড়লেও হাতপাখার দাম বাড়েনি। তাই সন্তানদের লেখাপড়ার খরচসহ সংসার চালাতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে। 

আরেক কারিগর লিপি রায় বলেন, এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এ পেশা টিকিয়ে রাখা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে সপ্তাহখানেক আগে গরমের সময় তাঁদের বেচাকেনা ভালো হয়েছে। 

কয়েকজন কারিগর জানান, একটি হাতপাখা তৈরি হতে লাগে কয়েকজনের শ্রম। পাখা তৈরির মূল উপকরণ তালপাতা, বেত, বাঁশ, প্লাস্টিক ও রং। প্রথমে তিন-চার ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে অথবা রোদে রাখা হয় তালপাতা। তারপর সেই পাতা সুবিধামতো আকারে কাটা হয়। এরপর সরু লম্বা কাঠি দিয়ে বেঁধে ও রং করে পাখা তৈরি করা হয়। মানভেদে একটি হাতপাখা ৫০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। এই পাখা বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে ঘোরে অনেকের সংসারের চাকা। 

পাখা কারিগর হারেছা আক্তারের স্বামী আবু হানিফ জানান, তালপাতা, বেত, বাঁশসহ হাতপাখা তৈরির মূল উপকরণের দাম বাড়ায় খরচ বেশি হয়। সরকার তাঁদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। 

অলকা রায় বলেন, আগে যে তালপাতা ছিল ১০ টাকা, এখন সেটা ৪০ টাকা। ১০০ টাকার বাঁশ হয়েছে ২০০ টাকা। এখন এ কাজ করে তাঁদের আর পোষাচ্ছে না। 

এ ব্যাপারে নিকলী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাকিলা পারভীন বলেন, প্রত্যন্ত হাওর অঞ্চলের সংগ্রামী এসব নারী ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছেন। তিনি খোঁজখবর নিয়ে তাঁদের সহযোগিতার ব্যবস্থা করবেন।