নিজ গ্রামে লটকনগাছ দেখে অবাকই হয়েছিলেন শামসুল আলম। ওই গাছে ফলনও হয়েছিল ভালো। তখন তিনি বুঝতে পারেন, তিনিও গ্রামে লটকন চাষ করতে পারবেন। এরপর তিনি বাণিজ্যিকভাবে লটকনের বাগান গড়ার পরিকল্পনা করেন। এ কাজে তিনি সফলও হয়েছেন। বর্তমানে তাঁর বাগানে প্রায় আড়াই হাজার লটকনগাছ আছে। গত বছর থেকে এসব গাছে ফল আসছে। লটকন বিক্রি শুরু করে বেশ লাভবান হয়েছেন শামসুল আলম।
শামসুল আলমের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার পাহাড়ি এলাকা রসুলপুর গ্রামে। গত বুধবার ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে লটকন। বিভিন্ন এলাকা থেকে ফল ব্যবসায়ীরা এসেছেন লটকন কিনতে। তাঁরা নিজেরাই বাগানে ঢুকে গাছ থেকে ইচ্ছেমতো লটকন সংগ্রহ করছেন। আর শামসুল আলম বসতঘরের সামনে বসে ওজন করে এগুলো বিক্রি করছেন।
ঘাটাইল সালেহা ইউসুফজাই বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের কৃষিবিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন শামসুল আলম। গত বছর অবসর নিয়েছেন। এরপর নিজের এই অবসর সময়ে লটকনের চাষাবাদ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তিনি। শামসুল বলেন, পরিকল্পনা করার পর ২০১৪ সালে লটকন চাষের জন্য খ্যাত এলাকা নরসিংদী গিয়ে বাগান দেখে আসেন। সেখানকার লটকনচাষিদের সঙ্গে কথা বলে নেন অভিজ্ঞতা। পরে সেখান থেকেই লটকনের বীজ সংগ্রহ করে নিজ হাতে চারা উৎপাদন করেন। তাঁর উৎপাদিত চারা বাড়ির পাশের সাড়ে সাত একর জমিতে রোপণ করেন। কিন্তু ফল আসে অনেক দেরিতে। ৫ থেকে ৬ বছর পর কিছু গাছে ফল আসতে শুরু করে। অন্যদিকে দুই হাজারের বেশি গাছ পুরুষ হওয়ায় সেগুলো কেটে ফেলেন তিনি। বর্তমানে তাঁর বাগানের আড়াই হাজার গাছে লটকনের ভালো ফলন হচ্ছে।
এখন বাড়ির কাছেই উন্নত মানের লটকন হচ্ছে। গত বছর থেকে শামসুল আলমের বাগান থেকে লটকন নিয়ে বিক্রি করছেন তিনি। মৌসুমে দুই দিন পরপর দু–তিন মণ লটকন বিক্রি করেন এই ব্যবসায়ী।ফল ব্যবসায়ী সাকের হোসেন
আশপাশের জেলা-উপজেলার ব্যবসায়ীরা শামসুলের বাগান থেকে লটকন কিনতে আসেন। গোপালপুর উপজেলা থেকে এসেছেন ফল ব্যবসায়ী আবদুল আজিজ। তিনি বলেন, এ বাগানের লটকন নরসিংদীর লটকনের চেয়ে অনেক সুস্বাদু। তাই বিক্রি হয় বেশি। ৭০ টাকা কেজি দরে তিনি লটকন কিনেছেন। কেজিপ্রতি আরও পাঁচ টাকা পরিবহন খরচ। গোপালপুরে নিয়ে তিনি ১৩০–১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করবেন।
নরসিংদী থেকে লটকন আনতে পরিবহন খরচ অনেক বেশি বলে জানান মধুপুরের গাংগাইর এলাকার ফল ব্যবসায়ী সাকের হোসেন। তিনি জানান, এখন বাড়ির কাছেই উন্নত মানের লটকন হচ্ছে। গত বছর থেকে শামসুল আলমের বাগান থেকে লটকন নিয়ে বিক্রি করছেন তিনি। মৌসুমে দুই দিন পরপর দু–তিন মণ লটকন বিক্রি করেন এই ব্যবসায়ী।
লটকন চাষে তেমন পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না বলে জানান শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘গাছ রোপণের পর পরিপূর্ণ বড় হতে প্রায় ১০ বছর লেগে যায়। তার পর থেকে ফলের উৎপাদন বাড়তে থাকে। প্রথমে আমি যখন লটকনের বাগান করি, তখন অনেকেই নিরুৎসাহিত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, আমাদের অঞ্চলে এটির ভালো ফলন হবে না। লোকসান হবে, কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। আজ প্রমাণিত হয়েছে, আমাদের এলাকায় লটকন চাষ সম্ভব।’
গত বছর প্রায় পাঁচ লাখ টাকার লটকন বিক্রি করেছেন শামসুল আলম। তাঁর প্রত্যাশা, এবার যে পরিমাণ লটকন হয়েছে, তা গতবারের চেয়ে অনেক বেশি টাকায় বিক্রি করতে পারবেন।
গাছ রোপণের পর পরিপূর্ণ বড় হতে প্রায় ১০ বছর লেগে যায়। তার পর থেকে ফলের উৎপাদন বাড়তে থাকে। প্রথমে আমি যখন লটকনের বাগান করি, তখন অনেকেই নিরুৎসাহিত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, আমাদের অঞ্চলে এটির ভালো ফলন হবে না। লোকসান হবে, কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। আজ প্রমাণিত হয়েছে, আমাদের এলাকায় লটকন চাষ সম্ভব।শামসুল আলম, লটকন চাষী ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
জেলার নিরাপদ ফল ও ফসল উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি ছানোয়ার হোসেন বলেন, শামসুল আলম মাস্টার লটকন চাষে সফল হয়ে প্রমাণ করেছেন মধুপুর-ঘাটাইলের পাহাড়ি এলাকায় লটকন চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে। লটকন চাষে কোনো রাসায়নিক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। তাই খুব কম খরচে এই ফল চাষ করা যায়।
ঘাটাইল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দিলশাদ জাহান বলেন, এ অঞ্চলের মাটি লটকন চাষের উপযোগী। শামসুল আলমকে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে পরামর্শসহ সার্বিক সহযোগিতা করা হয়। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লটকন চাষের সম্ভাবনা আছে এ অঞ্চলে।