সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার অজপাড়াগাঁ লক্ষ্মীনাথপুর। এই গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মেয়ে রাজিয়া সুলতানা (২১) সব প্রতিকূলতাকে জয় করে নারী ফুটবলে তৈরি করেছিলেন নিজস্ব অবস্থান। কিন্তু সাফজয়ী এ ফুটবলারকে নিয়তির কাছে হেরে গিয়ে কেবল ফুটবল থেকে নয়, পৃথিবী থেকেই চিরবিদায় নিতে হলো।
সন্তান জন্মের কয়েক ঘণ্টা পর অসুস্থ হয়ে রাজিয়া সুলতানা মারা গেছেন। গত বুধবার রাত ১০টার দিকে লক্ষ্মীনাথপুরে বাবার বাড়িতে একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দেন রাজিয়া। ওই দিন দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে বাবার বাড়ি থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়।
সাতক্ষীরা শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে লক্ষ্মীনাথপুর গ্রাম। এই গ্রামের নূর আলী আর আবিরন বিবি দম্পতির দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে সবার ছোট রাজিয়া। আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজিয়ার বাবার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দুই শতক জমির ওপর আধপাকা তিনটি ছোট ছোট ঘর। উঠানে কয়েক শ নারী-পুরুষ, সবাই শোকার্ত। কেউই রাজিয়ার অকালে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না। রাজিয়া ছিলেন গ্রামের সবার প্রিয়।
রাজিয়ার বাবা নূর আলী মারা গেছেন, বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে থাকেন কেবল মা আবিরন বিবি ও বড় ভাই ফজলুল হক। রাঙামাটির কাপ্তাই থেকে এসেছেন রাজিয়ার শাশুড়ি রোকেয়া খাতুন, স্বামী ইয়াম রহমান ও ভাশুর সিয়াম রহমান। তাঁরা মৃত্যুর জন্য দোষারোপ করছেন রাজিয়ার মা ও ভাইয়ের অবহেলাকে। তবে মা আবিরন বিবি বলেন, রাজিয়া সিজার করাতে চাননি। এ কারণে তিনি ক্লিনিক বা হাসপাতালে যেতে চাননি। তাই তাঁর প্রসববেদনা শুরু হলে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স আনা হলেও তিনি হাসপাতালে যাননি।
রাজিয়ার শাশুড়ি রোকেয়া খাতুন জানান, তিনি তাঁর নবজাতক নাতিকে নিয়ে তাঁদের গ্রামের বাড়ি কাপ্তাই উপজেলার পামহাউস গ্রামে আগামীকাল শনিবার যাবেন।
আজ দুপুর ১২টার দিকে রাজিয়ার বাবার বাড়িতে শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা জানাতে আসেন সাতক্ষীরা জেলা আন্তর্জাতিক ক্রীড়াবিদ ও সংগঠক ফোরামের আহ্বায়ক অবসরপ্রাপ্ত ফিফা রেফারি তৈয়ব হাসান, সংগঠনটির সদস্যসচিব ইমাদুল খান, সদস্য ইকবাল আলম, কালীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সুকুমার দাস, সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন ও সাংবাদিক মো. আহমদ্যাল্লাহ। তাঁরা সাতক্ষীরা জেলা আন্তর্জাতিক ক্রীড়াবিদ ও সংগঠক ফোরামের প্রধান উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি শেখ বশির আহমেদের দেওয়া এক লাখ টাকা ও কালীগঞ্জ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান হাফিজুর রহমানের দেওয়া রাজিয়ার নবজাতক সন্তানের জন্য উপহারসামগ্রী সন্তানের বাবা, দাদি ও নানির হাতে তুলে দেন।
রাজিয়ার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজিয়া ফুটবল খেলা শুরু করেন শৈশব থেকেই। ফজলুল হক আর রাজিয়া পিঠাপিঠি ভাই-বোন। ফজলুল হক গরু চরাতে যেতেন বিলে। তাঁর সঙ্গে যেতেন রাজিয়া। বিলে আরও অনেকে গরু চরাতে আসতেন। তাঁদের সঙ্গে বিলের মধ্যে রাজিয়ার ফুটবলে হাতেখড়ি। ছোটবেলায় গাছে ওঠা, মাছ ধরা, সাইকেল চালানোসহ দুরন্তপনা ছিল রাজিয়ার মজ্জাগত। ফুটবল কেনার মতো সামর্থ্য না থাকায় কখনো বাতাবিলেবু আবার কখনো খড়কুটা দিয়ে ফুটবল তৈরি করে খেলতেন।
কালীগঞ্জ উভাকুড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে রাজিয়া প্রথম অনেকের দৃষ্টিগোচরে আসেন। স্থানীয় ফুটবল কোচ ও শিক্ষক ইকবাল আলম এবং শিক্ষক আবদুল বারেক তাঁকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে তালিম দেওয়া শুরু করেন। রাজিয়া বাড়ি থেকে আট-নয় কিলোমিটার পথ প্রায় প্রতিদিন পায়ে হেঁটে কালীগঞ্জ সদরে এসে উপজেলা পরিষদ ফুটবল মাঠে তালিম নিয়ে আবার সন্ধ্যায় ফিরে যেতেন। তাঁর বড় বোন নাজমা খাতুন সঙ্গে আসতেন। ফিরে যাওয়ার সময় শিক্ষক বারেক তাঁদের ভ্যানে করে বাড়িতে যাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। ২০১২ সালের দিকে তৎকালীন কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরদার মোস্তফা শাহিন ও থানার ওসি হাসান হাফিজুর রহমান রাজিয়ার খেলায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে এক জোড়া বুট, জার্সিসহ খেলার সামগ্রী কিনে দেন।
রাজিয়ার বড় বোন নাজমা খাতুন (৩০) ভাই-বোনদের মধ্যে দ্বিতীয়। তিনি বলেন, খেলার পর পেটপুরে খাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না তাঁদের। তারপরও থেমে থাকেননি। খেয়ে না–খেয়ে বোনকে নিয়ে ছুটেছেন কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরা এমনকি খুলনায় খেলার মাঠে তালিম নিতে। সাতক্ষীরায় কোচ আকবর আলীর (২০২২ সালে প্রয়াত) জ্যোতি ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার পর টাকার অভাবে দিনের পর দিন বাড়িতে আসতে পারেননি রাজিয়া। মাঝেমধ্যে তিনি গিয়ে আদরের ছোট বোনকে দেখে এসেছেন।
ফজলুল হক ভাই-বোনদের মধ্যে চতুর্থ। তিনি বলেন, তাঁদের এলাকার হাফিজুল ইসলাম ও আলমগীর হোসেন সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে লেখাপড়া করতেন। তাঁরা রাজিয়াকে পরিচয় করিয়ে দেন নারী খেলোয়াড়দের ফুটবল কোচ আকবর আলীর সঙ্গে। আকবর তাঁর ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজিয়াকে ভর্তি করে নেন। দিনমজুর বাবার সন্তান রাজিয়ার বিনা খরচে থাকা–খাওয়া ও খেলাধুলা করার সব দায়দায়িত্বই নেন তিনি। ২০১২ সালে টাঙ্গাইলে ডিএফএ কাপ খেলতে গিয়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) দৃষ্টিতে আসেন। ডাক পান অনূর্ধ্ব-১৪ দলে। তার পর থেকে রাজিয়ার শুধু সামনের দিকে যাওয়া।
২০১১-১৪ সাল পর্যন্ত কোচ আকবরের তত্ত্বাবধানে ছিলেন রাজিয়া। তারপর ঢাকায় চলে যান। তার পর থেকে বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব-১৪, ১৫, ১৬, ১৮ ও ১৯ দলে খেলেছেন। দেশের বাইরে খেলেছেন ভারত, ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ ও সিঙ্গাপুরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কারও নিয়েছেন। ২০১৮ সালে ভুটানে অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন। সর্বশেষ ২০২০ সালে অনূর্ধ্ব ১৯ জাতীয় নারী ফুটবল দলে খেলেছেন। ওই বছরই অনূর্ধ্ব-১৮ জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার ও চট্টগ্রামের কাপ্তাই এলাকার একটি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা ইয়াম রহমানের সঙ্গে রাজিয়ার বিয়ে হয়। বিয়ের পর জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। তারপরও থেমে থাকেননি। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে লিগ খেলেছেন।
সাফজয়ী নারী ফুটবলার রাজিয়া মাঠে খেলতেন মিডফিল্ডার হিসেবে। সারা মাঠ দাপিয়ে খেলতেন। অন্যকে গোল করার জন্য বল তৈরি করে দিতেন। সব সময় হার না মানার মানসিকতা ছিল তাঁর। তবে শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেন মৃত্যুর কাছে।