রাজশাহীর বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহীদুর রহমানকে লাঞ্ছিত করার নেপথ্যে ১৯ কোটি টাকার কাজের ভাগ-বাঁটোয়ারা করার অভিযোগ উঠেছে। নগরের তেরখাদিয়া এলাকার কাজের ভাগ না পেয়ে মহানগর জামায়াতে ইসলামীর প্রয়াত এক নেতার ছেলের নেতৃত্বে রোববার সন্ধ্যায় শহীদুরকে লাঞ্ছিত করা হয়। এ সময় তাঁর কার্যালয়ে ভাঙচুরও করা হয়।
বিএমডিএ সূত্রে জানা গেছে, ভুক্তভোগী শহীদুর রহমান বিএমডিএর ‘ভূগর্ভস্থ সেচ নালা বর্ধিতকরণের মাধ্যমে সেচ এলাকার সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি)। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে আগে থেকেই প্রায় সাড়ে চার হাজার গভীর নলকূপ আছে। নলকূপগুলো ৬১০ মিটার এলাকায় সেচ দিতে পারে। সেটি পাইপলাইনের মাধ্যমে আরও ৫০০ মিটার করে সম্প্রসারণ করাই এ প্রকল্পের কাজ।
সম্প্রতি পিডি শহীদুর রহমান ৯৫টি লটে পাইপলাইন সম্প্রসারণ কাজের দরপত্র আহ্বান করেন। প্রতিটি লটের কাজের টাকার পরিমাণ ২০ লাখ। মোট ১৯ কোটি টাকার কাজের ‘ভাগ’ চাওয়া নিয়েই পিডিকে লাঞ্ছিত ও কার্যালয়ে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ইতিমধ্যে ঠিকাদারেরা দরপত্র দাখিল করলেও কাজ কে পাচ্ছেন, সেই ফলাফল এখনো প্রকাশিত হয়নি।
ঠিকাদারদের একটি সূত্র জানিয়েছে, বিএমডিএতে এখন হালুয়া-রুটির মতো কাজ ভাগাভাগি চলছে। ‘এটা বিএনপির অমুক নেতার কাজ, ওটা আরেক নেতার’—এভাবেই কাজ ভাগ হচ্ছে।
তবে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ আলী অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। এই প্রথম শুনলেন। যদি কাজ ভাগাভাগি হয়, সেটা বিএমডিএ বলতে পারবে।
প্রত্যক্ষদর্শী একটি সূত্র জানায়, গতকাল সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ১৫ থেকে ২০ জন ব্যক্তি পিডি শহীদুর রহমানের কার্যালয়ে যান। দলটির নেতৃত্বে ছিলেন মহানগর জামায়াতের প্রয়াত আমির আতাউর রহমানের ছেলে সাকিব। তিনি নগরের তেরখাদিয়া এলাকার বাসিন্দা এবং মহানগর জামায়াতের আরেক নেতার শ্যালক। তাঁরা পিডি শহীদুরের কাছে গিয়ে তাঁদের কাজ দেওয়ার দাবি করেন। কিন্তু পিডি তাঁদের জানান, ই-জিপি সিস্টেমের বাইরে তিনি কিছুই করতে পারবেন না। এ নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা শুরুর একপর্যায়ে তাঁরা পিডি শহীদুরকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। এ ছাড়া তাঁর টেবিলের কাচ ও কার্যালয়ের বাইরের দেয়ালে থাকা একটি ফ্যান ভাঙচুর করেন। পরে পিডিকে শাসিয়ে চলে যান।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত সাকিবের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মহানগর জামায়াতের প্রচার ও মিডিয়া সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াতের প্রয়াত ওই নেতার ছেলে বিএমডিএতে যেতে পারেন। তাঁর সঙ্গে জামায়াতের সাংগঠনিক কোনো সম্পর্ক নেই। এটা এলাকাভিত্তিক একটা ঘটনা। তেরখাদিয়ার লোকজন সেখানে গিয়েছিলেন। তেরখাদিয়ার লোক হিসেবে সাকিব হয়তো গিয়েছিলেন। জামায়াতের কথা হলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে যে ঠিকাদার যোগ্য, তিনিই কাজ পাবেন। এটাই তাঁদের দলের অবস্থান।
পিডি লাঞ্ছিতের ঘটনার পর নগরের রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশরাফুল আলম আজ সোমবার সকালে শহীদুর রহমানের কার্যালয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। প্রায় ১৫ মিনিট তিনি ঘটনার বর্ণনা শোনেন। বের হওয়ার পর এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওসি আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, অন্য মাধ্যম থেকে খবর পেয়ে তিনি এসে সব শুনেছেন। পিডি চাইলে থানায় অভিযোগ করতে পারেন। তাহলে তাঁরা আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেবেন। এখন তাদের (বিএমডিএ) নির্বাহী পরিচালক ঢাকায় আছেন। তিনি আসার পর তাঁরা সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে জানিয়েছেন।
কাজ ভাগ-বাঁটোয়ারার বিষয়ে পিডি শহীদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই অভিযোগ সঠিক নয়। দরপত্র দাখিল হয়েছে। রেজাল্ট এখনো হয়নি। কে কাজ পাচ্ছে না পাচ্ছে, আমি নিজেও জানি না।’ তিনি বলেন, নিয়ম হলো একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান একাধিক লটের জন্য দরপত্র দাখিল করতে পারবেন। কিন্তু একটির বেশি কাজ পাবে না। রোববার সন্ধ্যায় তাঁর দপ্তরে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা ১৫ থেকে ২০টি লটের কাজ দাবি করেন। একটি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে একাধিক কাজও দাবি করেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, ই-জিপিতে যোগ্য ঠিকাদারই কাজ পাবেন। এর বাইরে তিনি কিছু করতে পারবেন না। এরপর তাঁরা হট্টগোল করেন।
তবে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা বা কার্যালয়ে ভাঙচুরের কথা অস্বীকার করেন শহীদুর রহমান। থানায় অভিযোগ করবেন কি না, জানতে চাইলে বলেন, ‘নির্বাহী পরিচালক স্যার ঢাকায় আছেন। তিনি ফেরার পর আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’
জানতে চাইলে বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ধরনের ঘটনা দুঃখজনক। আমরা এটা প্রত্যাশা করি না। এ ঘটনার পর আমি কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে কি না। আমি জেনেছি, এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে তখন কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এবার কী করা যায় আমরা দেখছি।’
পরে সন্ধ্যায় মুঠোফোনে কল করে শফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি এখন ঢাকায় আছেন, কাল রাজশাহীতে ফিরবেন। ইতিমধ্যে ঘটনাটি তিনি কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিবকে জানিয়েছেন। এ ঘটনায় বিএমডিএর চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।