ছিটমহল বিনিময়ের সাত বছর

উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে গেছে ‘বঞ্চিত’ জনপদ

একসময় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে ‘মিথ্যা’ পরিচয় দিতে হতো। ছিটমহলের লোক জানতে পারলে সবখানে তাচ্ছিল্য করা হতো। সন্তানদের স্কুলে ভর্তিতে ব্যবহার করতে হতো বাংলাদেশে বাস করা আত্মীয়স্বজনদের ঠিকানা। এখন বাড়ির কাছেই কমিউনিটি ক্লিনিক। চিকিৎসার পাশপাশি ওষুধও মেলে বিনা মূল্যে। ছেলেমেয়েরা স্কুলেও যেতে পারে। রাস্তাঘাট পাকা হয়েছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো জ্বলছে। সরকারের দেওয়া পাকা ঘরও পেয়েছেন কেউ কেউ।

বিদ্যালয়ের ছুটি শেষে বাড়ি ফিরছে শিক্ষার্থীরা। গত শনিবার লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বিলুপ্ত বাঁশকাটা ছিটমহলে
ছবি: প্রথম আলো

এ পরিবর্তন নিয়ে পঞ্চগড় সদর উপজেলার বিলুপ্ত গাড়াতি ছিটমহলের পূর্ব রাজমহল এলাকার বাসিন্দা হাজেরা বেগমের (৪৫) ভাষ্য, ‘হয়তো বেশি কষ্টে ছিলাম বলে বেশি সুখ পাচ্ছি। জীবনে কোনোদিন ভাবিনি, ছিটমহলের এত পরিবর্তন হবে।’

দীর্ঘ ৬৮ বছরের বঞ্চনার অবসানের সাত বছরের মাথায় বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষের জীবনচিত্র। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের পর জনপদগুলো ঘিরে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হাতে নেয় সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘদিন সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত জনপদে এসেছে আমূল পরিবর্তন।

গতকাল রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পঞ্চগড়ের বিভিন্ন বিলুপ্ত ছিটমহল ঘুরে দেখা যায়, ঘরে ঘরে জ্বলছে বিদ্যুতের আলো। পাকা হয়েছে রাস্তাঘাট, গড়ে উঠেছে নতুন নতুন স্কুল-কলেজ। প্রতিটি পরিবার ব্যবহার করছে স্যানিটারি ল্যাট্রিন ও নলকূপ। মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছেন স্থানীয় কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয়। বাসিন্দারা পেয়েছেন জমির মালিকানা। একই চিত্র দেখা গেছে, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতেও।

১৯৭৪–এর স্থল সীমান্ত চুক্তি (মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি) বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাংলাদেশে ও ভারতের মধ্যে বিনিময় হয় ১৬২টি ছিটমহলের। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখণ্ড এবং ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতের ভূখণ্ড হয়ে যায়। দিবসটি উপলক্ষে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

পঞ্চগড়ের ছিটমহলগুলোতে পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। গতকাল সকালে পঞ্চগড় সদর উপজেলার বিলুপ্ত গাড়াতি ছিটমহলে

পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, পঞ্চগড় সদর, বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলার বিলুপ্ত ৩৬টি ছিটমহলের মধ্যে ১৭টিতে জনবসতি রয়েছে। বাসিন্দার সংখ্যা ১৯ হাজার ২৪৩। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) মাধ্যমে এসব এলাকায় ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০২ কিলোমিটার পাকা রাস্তা এবং ১১ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০টি ব্রিজ-কালভার্ট, ১১টি মসজিদ, ৪টি মন্দির, ৫টি বাজার, ১টি কবরস্থান ও ২টি নদীর ঘাটলা নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা ব্যয়ে পঞ্চগড় সদর ও বোদা উপজেলায় তিনটি কমিউনিটি সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোয় ডিজিটাল পোস্ট অফিসও স্থাপন করা হয়েছে।

এ ছাড়া স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে পাঁচটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। ৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে ১৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩টি মহাবিদ্যালয় ও ১টি মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়েছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ২৩৮ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন করে ৮ হাজার গ্রাহককে বিদ্যুৎ–সংযোগ দিয়েছে।
এদিকে ভূমি জরিপ অধিদপ্তর বিলুপ্ত ছিটমহলের জমির ডিজিটাল জরিপ শেষ করে চূড়ান্ত খতিয়ান প্রস্তুত করেছে। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় কেবল পঞ্চগড়েই ৩৪৯টি টিনশেড পাকাঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।

লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি বিলুপ্ত ছিটমহল রয়েছে। এর মধ্যে পাটগ্রামেই রয়েছে ৫৫টি। এসব ছিটমহলে বাসিন্দার সংখ্যা ৮ হাজার ৪৫২।

পাটগ্রাম উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, পিডিবি ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪০ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় সব বাড়িতে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এলজিইডি সড়ক, কালভার্ট, সেতু, বাজার, মসজিদসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে টিউবওয়ে, স্যানিটেশন–সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর মাধ্যমে স্থানীয় ব্যক্তিদের সেলাই প্রশিক্ষণ, গাভি পালন প্রশিক্ষণ ও ব্যাংকঋণ প্রদান চলমান রয়েছে। ধীরে ধীরে সব নাগরিক সুবিধাই পাচ্ছেন তাঁরা।

উপজেলার বিলুপ্ত বাঁশকাটা ছিটমহলের বাঁশকাটা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির নেতা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তো বাংলাদেশি হয়ে গেছি। ভোটের তালিকায় নাম উঠেছে। আরও কত কিছু হবে। ৬৮ বছর ধরে আমরা কোনো উন্নয়ন দেখিনি বা উন্নয়নের কথা বলতে পারিনি। এখন তো বলতে পারছি।’

বিলুপ্ত গাড়াতি ছিটমহলের হুদুপাড়া এলাকার বাসিন্দা বিজয় বর্মণ (৭৩) বলেন, ‘বদ্ধ ঘরে ঢুকে চারদিক তাকালে যেমন লাগে, আগে আমাদের ঠিক তেমন লাগত। এখন মনে হচ্ছে আমাদের আকাশটারও পরিবর্তন হয়েছে। স্বাধীনভাবে দেখতে পারি। যখন যেখানে ইচ্ছা যেতে পারি, সব সুবিধা নিতে পারি।’

ছিটমহলে একসময় কেউ কোনো অপরাধ করলে বিচার হতো না। এখন সেই চিত্র বদলেছে। গাড়াতি ছিটমহলের বাসিন্দা আজিরন বেগম (৪৮) বলেন, ‘একসময় দিনে–দুপুরে আমাদের পালিত মুরগি-ছাগল লুটপাট হতো। কারও কাছেই বিচার পেতাম না। এখন আমরা ভোট দিচ্ছি, আমাদের এলাকায় বিচার সালিসও হচ্ছে। ওই সময় জন্মের পর আমাদের বাচ্চাদের টিকাও দিতে পারতাম না। আর এবার আমরা করোনারও টিকা পেয়েছি।’