মে দিবস

ঘামের দামে কষ্টে চলে তাঁদের জীবনসংসার

ইটভাটার কাজে হাড়ভাঙা পরিশ্রম। সে অনুযায়ী পারিশ্রমিক মেলে না শ্রমিকদের। খুব কষ্টে চলে তাঁদের সংসারের চাকা।

তপ্ত দুপুরে কঠোর পরিশ্রম করেন ইটভাটার শ্রমিকেরা। দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা মজুরি পান। এই উপার্জনেই চলে তাঁদের জীবনসংসার। মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার ভাটবাউর এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

কাঠফাটা রোদে তপ্ত দুপুর। ইটভাটার খোলা (যেখানে ইট পোড়ানো হয়) থেকে ইটের উচ্ছিষ্ট পোড়ামাটি ঝাঁকায় ভরে মাথায় করে নিয়ে পাশের একটি স্থানে স্তূপ করে রাখছেন শ্রমিকেরা। মাঝেমধ্যে শরীর থেকে বের হওয়া ঘাম হাত দিয়ে মুছছেন। প্রচণ্ড গরমে তাঁদের নাস্তানাবুদ অবস্থায়। গতকাল রোববার দুপুর ১২টার দিকে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার ভাটবাউর এলাকায় একটি ভাটায় গিয়ে এই দৃশ্য দেখা যায়। জীবনসংসারের চাকা সচল রাখতে ওই সব শ্রমিকের প্রতিদিনই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ চালিয়ে যেতে হয়। তাঁরা জানেন না মে দিবসের তাৎপর্য কী।

বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম, এই উপার্জনের ট্যাকায় টাইন্যা-টুইন্যা কোনো রহমে সংসার চলে। অন্য কাজ পাই না, বাধ্য হয়ে এই কাম করছি।
আবদুর রহিম, ইটভাটার শ্রমিক

রহমান ব্রিকস নামের ইটভাটাতে প্রায় ১৮ বছর ধরে কাজ করেন আবদুর রহিম (৫০)। তাঁর বাড়ি সদর উপজেলার দীঘি ইউনিয়নের মুলজান গ্রামে। স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তাঁর পরিবার। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। সংসারে তাঁর স্ত্রী ও কলেজপড়ুয়া ছেলে। এই ভাটায় কাজ করেই চলছে তিন সদস্যের সংসার। রহিমের স্ত্রী সাজ্জান বেগম গৃহবধূ। ছেলে টুটুল হোসেন এবার এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করেছেন। স্নাতকে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

ইটভাটাটির শ্রমিকদের পারিশ্রমিক নির্ভর করে তাঁদের কাজের সময়সীমার ওপর। ভোর পাঁচটা থেকে বিকেলে পাঁচটা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা কাজ করলে ৮০০ টাকা পাওয়া যায়। তবে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে দীর্ঘ সময় কাজ করতে পারেন না আবদুর রহিম। প্রতিদিন সাত থেকে আট ঘণ্টা কাজের বিনিময়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় তাঁকে। তিনি বলেন, ‘বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম, এই উপার্জনের ট্যাকায় টাইন্যা-টুইন্যা কোনো রহমে সংসার চলে। অন্য কাজ পাই না, বাধ্য হয়ে এই কাম করছি।’

আবদুর রহিমের সঙ্গে মাথায় করে ইটের উচ্ছিষ্ট পোড়ামাটি ভাটায় অন্য স্থানে নিয়ে রাখছিলেন সদর উপজেলার পাথরাইল গ্রামের মঙ্গল মিয়া (৪০)। কাজের ফাঁকে কথা হয়, তাঁর সঙ্গেও। মঙ্গল মিয়া বলেন, পরিবারে স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে। তাঁদের নিয়েই তাঁর জীবনসংগ্রাম। দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরি পান। এই স্বল্প উপার্জনে খুব কষ্টে চলছে তাঁর সংসারের চাকা।

রহিম ও মঙ্গলের মতো ভাটার প্রায় সব শ্রমিকের জীবনসংগ্রামের গল্প প্রায় একই। পাশের জামাল ব্রিকস নামের অপর একটি একটি ইটভাটায় কাজ করছিলেন শ্রমিক মোকতাজুর রহমান (৪০)। তিনি এক যুগের বেশি সময় ধরে ভাটায় ইট পরিবহনের কাজ করছেন। গতকাল দুপুরে মোকতাজুর ওই ভাটাতেই সারিবদ্ধভাবে ইট সাজিয়ে রাখছিলেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার সাতানী ভাদ্রা গ্রামে। সেখানেই স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ে ও মা-বাবা থাকেন।

মোকতাজুর বলেন, ‘ইটভাটার কাজটাই হাড়ভাঙা পরিশ্রমের। ভাটার তাপের পাশাপাশি রোদের মধ্যে কাজ করতে হয়। কিন্তু পরিশ্রম অনুযায়ী মজুরি কমই। ১২ ঘণ্টা কাজ করে ৮০০ ট্যাকা পাই। এই ট্যাকায় বাড়িতে পরিবারের খরচ দিতে হয়। এখানে নিজেরও তো খরচ আছে।’

এসব ভাটায় শুধু পুরুষ শ্রমিকেরাই কাজ করেন না, নারী শ্রমিকেরা সমানতালে কাজ করছেন। তবে পুরুষের থেকে নারী শ্রমিকদের মজুরি কিছুটা কম বলে জানালেন ভাটায় কাজ করা কয়েকজন নারী শ্রমিক। ইটভাটায় প্রায় এক যুগ ধরে কাজ করছেন সদর উপজেলার ছুটিভাটবাউর গ্রামের বিধবা রুবিয়া বেগম (৫০)। তিনি ভাটায় ইট পোড়াতে ব্যবহৃত কয়লা ভাঙার কাজ করেন।

রুবিয়া বলেন, নিজের থাকার জায়গা নেই। অন্যের জায়গা কোনোরকমে ঘর তুলে থাকছেন। অসুখে ভুগে স্বামী জালাল উদ্দিন প্রায় এক বছর আগে মারা যান। দুই ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে বিয়ে করার পর আলাদা সংসার পেতেছেন। বড় ছেলে রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।

সকাল আটটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করে ৩২০ টাকা মজুরি পান বলে জানান রুবিয়া। তিনি বলেন, ‘মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য একটুকরো জমি দরকার। বড় ছেলে কাজ করলেও ওরও মজুরি কম। দুই মা-ছেলে যা কামাই (উপার্জন), তা দিয়ে কষ্ট করে সংসার চালাই। আর সামান্য কিছু করে ট্যাহা জমাই, যদি একটু থাহার (থাকার) জায়গা কিনতে পারি।’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা কমিটির সহসভাপতি ইকবাল হোসেন বলেন, দেশের ইটভাটার শ্রমিকদের সুরক্ষা নেই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় তাঁদের। এসব শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা জরুরি, যা দিয়ে তাঁরা পরিবার নিয়ে কিছুটা হলেও সচ্ছলভাবে চলতে পারেন।