বাঙালির প্রাণের উৎসব নববর্ষ ঘিরে বরিশালে কুমারপাড়ায় ব্যস্ততা বেড়েছে। সারা বছর মৃৎশিল্পীদের কদর না থাকলেও বৈশাখ উপলক্ষে তাঁরা দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। মৃৎশিল্পীরা বলছেন, নববর্ষে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মেলা বসে। সারা বছর মাটির তৈজস বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করলেও মেলার কারণে বাহারি সব খেলনা তৈরি করেন। যদিও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তাঁদের অনেকে পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন।
শিল্পবোদ্ধারা বলছেন, হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অনবদ্য রূপ মৃৎশিল্প। এর সঙ্গে একদিকে জড়িয়ে আছে জীবনের প্রয়োজন, অন্যদিকে নান্দনিকতা ও চিত্রকলার বহিঃপ্রকাশ। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ নিয়ে পেশাটি বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
বরিশালের গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, বাকেরগঞ্জ ও বাবুগঞ্জ উপজেলার পালবাড়িগুলোতে চলছে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা। মাটির তৈজসপত্রের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের খেলনা তৈরি করছেন মৃৎশিল্পীরা। মাটির পুতুল, হাতি, ঘোড়া, নৌকা, টিয়া, সিংহ, দোয়েল, কচ্ছপ, মাছ, হাঁসসহ নানা রকম ফল, ফুল আর বাহারি মাটির ব্যাংক, প্লেট, মগ, গ্লাস, চায়ের কাপ, পিঠা তৈরির ছাঁচ তৈরি হচ্ছে সমানতালে। পয়লা বৈশাখের পর এসব জিনিস বিক্রি করা হবে।
সম্প্রতি বাকেরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কলসকাঠি ও নিয়ামতি কুমারপাড়া ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের মাটির তৈরি সামগ্রী বানাতে ব্যস্ত কারিগরেরা। জরাজীর্ণ আবাসগুলোতে কেউ মাটি ঘুটছেন, কেউ সেই মাটি ছাঁচে দিয়ে তৈজসপত্র তৈরি করছেন। কেউবা খেলনা শুকানোর পর রং–তুলির আঁচড় দিচ্ছেন।
কলসকাঠির কমল পাল প্রথম আলোকে বলেন, এখন মাটির জিনিসের কদর নেই। সারা বছর টানাপোড়েনের মধ্যে সংসার চলে। পূর্বপুরুষের পেশা হওয়ায় ইচ্ছা হলেও ছাড়তে পারেন না। বৈশাখী মেলায় মাটির তৈরি খেলনা ও জিনিসপত্রের চাহিদা থাকে। এ সময়ে ভালো আয় হয়।
দেশজুড়ে বাকেরগঞ্জের মৃৎশিল্পের খ্যাতি আছে। কিন্তু এ খ্যাতি শিল্পীদের জীবনমান বদলাতে পারেনি। দারিদ্র্য আর সীমাহীন বঞ্চনার মধ্যে তাঁরা পূর্বপুরুষের পেশা এখনো আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। বাংলা নববর্ষ ঘিরে তাঁদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে।
কমল পালের স্ত্রী প্রিয়াঙ্কা পাল বলেন, মৃৎশিল্পের জন্য প্রয়োজন পরিষ্কার এঁটেল মাটি। কিন্তু এখন মাটি পাওয়া যায় না। তার ওপরে রং, শ্রমিকদের মজুরি এবং আনুষঙ্গিক ব্যয় বেড়েছে। সে অনুযায়ী উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়েনি। এরপরও পূর্বপুরুষেরা পেশাটির সঙ্গে ছিলেন। তাঁরাও সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।
মৃৎশিল্পে নিয়োজিত কারিগরেরা বলছেন, এখন আর তাঁদের সমৃদ্ধির আশা নেই। পূর্বপুরুষের কাছ থেকে শেখা কাজের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শিকড়ের টানে এখনো আঁকড়ে ধরে আছেন। কুমারদের এখন বড় দুর্দিন। আগের মতো তাঁদের তৈরি মালামাল বাজারে চলে না। মাটির খেলনা, তৈজস তৈরিতে ব্যয় অনেক বেড়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী দাম নেই।
কমল পালের ভাষ্য—‘সবাই বলে মৃৎশিল্প ঐতিহ্যের অংশ। কিন্তু ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে কারও কোনো উদ্যোগ নেই। আমাদের পুঁজি নেই, পণ্য বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা নেই। আমাদের প্রায় সবারই ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নেওয়া। কিস্তি দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। তবু কী করব, অন্য কাজ জানি না বলে পেশাটি আঁকড়ে আছি।’
স্থানীয় পালদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০–২৫ বছর আগেও বাকেরগঞ্জে মৃৎশিল্পে জড়িত কুমাররা খেয়ে-পরে ভালো ছিলেন। তখন উপজেলার কলসকাঠি ও নিয়ামতি ইউনিয়নে প্রায় এক হাজার পরিবার মাটির জিনিস তৈরি করতেন। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নয়নে মাটির তৈরি এসব জিনিসের বদলে বাজার দখল করছে প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল ও সিরামিকে। তাই আধুনিক তৈজসপত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে মাটির তৈরি অনেক পণ্য হারিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে পালদের নতুন প্রজন্ম এখন অন্য পেশায় ভিড়ছে।
বাকেরগঞ্জের নিয়ামতি ইউনিয়নের পালপাড়ার হরি পাল ও স্বপন পাল অভিযোগ করে বলেন, মৃৎশিল্প টিকিয়ে রাখতে শিল্পের সম্প্রসারণ, আধুনিকায়ন ও বাজারজাতকরণে সরকারি-বেসরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই। পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে মাটির তৈরি পণ্য রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হতো।
মৃৎশিল্পীদের জীবনমান নিয়ে কাজ করেন বরিশাল চারুকলার সংগঠক সুশান্ত ঘোষ। তিনি বলেন, সভ্যতার সূচনাপর্বে মানুষ মৃৎশিল্পের ধারাবাহিক উৎকর্ষের পরিচয় দিয়েছে। এ শিল্প যেমন মানুষের প্রয়োজন মিটিয়েছে, তেমনি নান্দনিকতার ছাপ রেখেছে। তিনি বলেন, প্রাচীনকাল থেকে বরিশালের মৃৎশিল্পীদের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন স্থানে। এ অঞ্চলের কলসকাঠি, মহেশপুর, গৈলা, বাউফলে এর বিকাশ ঘটেছিল। কিন্তু সেই ঐতিহ্য তাঁরা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ধরে রাখতে পারেননি।
সুশান্ত ঘোষ বলেন, ‘ঐতিহ্যের স্বার্থে আমাদের মৃৎশিল্পের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা বরিশাল চারুকলার পক্ষ থেকে প্রতিবছর এ অঞ্চলের মৃৎশিল্পীদের সম্মাননা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করে কিছুটা হলেও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু এটা ব্যাপকভাবে হওয়া উচিত।’