ডাকঘর ভবনের আদলে পূজামণ্ডপটির ওপরের অংশটি করা হয়েছে। আজ রোববার সকালে রাজশাহী নগরের গণকপাড়া এলাকায়
ডাকঘর ভবনের আদলে পূজামণ্ডপটির ওপরের অংশটি করা হয়েছে। আজ রোববার সকালে রাজশাহী নগরের গণকপাড়া এলাকায়

ডাক ভবনের আদলে পূজামণ্ডপ, পুরো প্রাঙ্গণে রানার, চিঠি-ডাকটিকিটের ছড়াছড়ি

পূজামণ্ডপ ঘুরতে এসে সরছিলেন না রাজশাহী নগরের বাসিন্দা আবুল হোসেন (৪৫)। একটি চিঠি পড়ে আটকে গিয়ে বললেন, ‘আহা...! কী চিঠি, কী ভাষা।’ তিনি পড়ছিলেন ১৯৫০ সালের একটি বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র।

চিঠিটির ভাষা এমন—‘ভাই, নুরুন্নাহারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছি বিয়ে গ্রন্থিতে। আসছে একুশ আগস্ট, সোমবার, বর্ষামেদুর উত্তর-সন্ধ্যায়। পরীবাগে সে অনুষ্ঠান। তুমি আসবেই, আনন্দ-খুশির কল্লোল তুলবেই, অনুরোধ নয়, অধিকার। ইতি- মোকসুদ। ঢাকা ১৪ আগস্ট, ৫০।’

আবুল হোসেন বলেন, ‘দেখেন, পড়তে পড়তে কেমন শিহরিত হয়ে পড়ছি না! এগুলো কিন্তু মোবাইল মেসেজে সম্ভব নয়।’

রাজশাহী নগরের গণকপাড়া এলাকায় পূজামণ্ডপের পাশে বিভিন্ন সময়ের ডাকটিকিট সাঁটানো হয়েছে

গতকাল শনিবার দুপুরে আবুল হোসেন থমকে দাঁড়িয়েছিলেন রাজশাহী নগরের গণকপাড়া এলাকায় টাইগার সংঘ নামে একটি পূজামণ্ডপে। মণ্ডপটি বাংলাদেশ ডাক ভবনের আদলে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কয়েক বছর ধরে পূজামণ্ডপটি বিভিন্ন ব্যতিক্রম থিমে সেজেছে। কখনো আইয়ুব বাচ্চুর রুপালি গিটারে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, বাহুবলী, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, করোনাকালে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্কের আদলে কিংবা বিশ্বকাপের ট্রফিতে। এবার ডাক বিভাগের চিত্র তুলে ধরা হলো।

ঢাকায় আগারগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ভবনের আদলে পূজামণ্ডপটির ওপরের অংশটি করা হয়েছে। সেই ভবনের নিচে ভেতরে মা দুর্গাকে রাখা হয়েছে। মনে হতে পারে ডাক ভবনের ভেতরে প্রবেশ করতেই দুর্গার প্রতিমা। দুই পাশে রাখা হয়েছে দুষ্প্রাপ্য ও ঐতিহাসিক ডাকটিকিটের ছবি। ডাকটিকিটে গ্রামবাংলার চিত্রসহ বাংলাদেশের নানা সাফল্য তুলে আনা হয়েছে। মণ্ডপে ঢুকতেই ডান পাশে বড় করে লাগানো চিঠি পাঠানোর ঠিকানা লেখার স্থান। মণ্ডপের সামনে দাঁড়ালে ডাকঘর আদলে করা ভবনের সামনে দেখা যায়, প্রাঙ্গণজুড়ে রানারের প্রতিকৃতি। মণ্ডপের বাইরের দিকে দুই পাশে পুরোনো দিনের চিঠি একত্র করে বোর্ডে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই রকম বড় বড় দুই বোর্ডে ১২টি করে ২৪টি চিঠি রয়েছে।

প্রাঙ্গণজুড়ে রানারের প্রতিকৃতি। আজ রোববার সকালে রাজশাহী নগরের গণকপাড়া এলাকায়

২৪টি চিঠির মধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা চিঠি রয়েছে। তেমনই রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যজিৎ রায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো মানুষের হাতে লেখা চিঠি। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালে মওলানা ভাসানীকে একটি চিঠিতে সে সময়ের দেশের কথা তুলে ধরেছেন। শওকত ওসমানকে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘আছে সত্যের পূর্ণ স্বরূপ চূর্ণিত পরমাণুতে/আছে দেহাতীত অজানা অরূপ তোমার বদ্ধ তনুতে।’

মণ্ডপ ঘুরতে আসা দর্শনার্থী শিখা রানী বলেন, তিনি প্রতিবছর প্রায় ২০ থেকে ৩০টির মতো মণ্ডপে ঘুরতে বের হন। যে মণ্ডপ আকৃষ্ট করে, সেখানেই বেশি সময় থাকেন। এবার তাঁর কাছে টাইগার সংঘের থিমটি ভালো লেগেছে। এতে তরুণ প্রজন্ম চিঠির সেই ইতিহাস কিছুটা হলেও জানতে পারবে।

মণ্ডপের বাইরের দিকে দুই পাশে পুরোনো দিনের চিঠি একত্র করে বোর্ডে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। শনিবার দুপুরে রাজশাহী নগরের গণকপাড়া এলাকায়

টাইগার সংঘের সভাপতি সুশীল কুমার আগরওয়ালা বলেন, অনেকে চিঠি লেখা ভুলেই গেছেন। চিঠিটা কীভাবে লিখতে হয়, কীভাবে ঠিকানা লিখতে হয়, সেটাও অনেকেই জানেন না। ছোটবেলায় দেখা যেত, ডাকপিয়ন দরজায় কড়া নাড়লে কে আগে বের হয়ে গিয়ে চিঠি নেবে, তা নিয়ে কাড়াকাড়ি হতো। চিঠি পাওয়ার কী আবেগ, কী আকুলতা তখন ছিল। চিঠির অস্তিত্ব থাকে বলেই, শত বছরের পুরোনো চিঠি এখনো স্পর্শ করা যায়। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির যোগাযোগ অনিশ্চিত ও সাময়িক।