রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ তদন্ত কমিটি পর্যন্তই

ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি-মারধরের  ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়। কোনো প্রতিকার নেই।

জিনিসপত্রসহ আবাসিক শিক্ষার্থী আকিব জাভেদকে কক্ষের বাইরে বের করে দেওয়া হয়। গত বছরের ১২ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই-বাংলা ফজলুল হক হলে
ফাইল ছবি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয় ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, মারধর, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সিট-বাণিজ্যের ঘটনায় গত ২০২১ ও ২০২২ সালে অন্তত ২৩টি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দেওয়া অভিযোগ ঘিরে ১৩টি তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ৬টির। তবে কোনো ঘটনায় ছাত্রলীগের কাউকে শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মনে করছেন, এসব ঘটনায় শাস্তি না হওয়ায় আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য কমছে না।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টায় শাহ্‌ মখদুম হলের এক শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনা ঘটে। ওই দিন ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি ও মারধরের শিকার হন ফোকলোর বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. সামিউল ইসলাম। ঘটনার পর তিনি ভয়ে বৃহস্পতিবার রাতে হলের বাইরে থাকেন। গতকাল শুক্রবার প্রশাসনের হস্তক্ষেপে হলে ফেরেন সামিউল।

করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমে এলে ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর হল খুলে দেওয়া হয়। আগের মতোই ছাত্রলীগের নেতারা হলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রলীগ শুরুতে আসন দখল করতে আবাসিক হলের কক্ষগুলোয় তালা মারতে শুরু করে। এরপর বৈধভাবে হলে ওঠা শিক্ষার্থীদের নানা কায়দায় হলছাড়া করে। ২০২১ ও ২০২২ সালে অন্তত ২৩ জন শিক্ষার্থীকে বিভিন্নভাবে হল থেকে বের করে দেয় ছাত্রলীগ। এমন ঘটনাকে ঘিরে হল প্রাধ্যক্ষদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে গত বছর উদ্যোগ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত বছরের ১ জুলাই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে অবৈধদের বের করে দিয়ে রাতভর বৈধ শিক্ষার্থীদের হলে তোলা হয়। তুলে দেওয়া ২০ শিক্ষার্থী এখনো হলেই আছেন। এরপর হলের সিট দখলের দৌরাত্ম্য কমতে থাকে। এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার আবারও এমন ঘটনা ঘটল। 

প্রশাসনের অবশ্যই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিধি অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তা ছাড়া ক্যাম্পাসে এগুলো চলতেই থাকবে।
অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আগের ঘটনাগুলো

গত বছরের ২৪ জুন গভীর রাতে নবাব আবদুল লতিফ হলের ২৪৮ নম্বর কক্ষ থেকে রসায়ন বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. মুন্না ইসলামকে মারধর করে বের করে দেওয়া হয়। 

এরপর মারধর ও নির্যাতনের শিকার হয়ে তথ্য ও হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আল-আমিন ক্যাম্পাস ছাড়েন। পরে তিনি গত বছরের ২৬ আগস্ট প্রক্টরের দপ্তরে অভিযোগসংবলিত একটি চিঠি কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠান। আল-আমিনকে গত বছরের ১৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে নির্যাতন করা হয়। আল-আমিনের অভিযোগ, নির্যাতনের পর ছাত্রলীগের দুই নেতা তাঁর ডেবিট কার্ড থেকে ৪৫ হাজার টাকাও তুলে নেন।

গত বছরের ১৯ আগস্ট মতিহার হলে চাঁদা না দেওয়ায় অর্থনীতি বিভাগের সামছুল ইসলামের কানের পর্দা ফাটিয়ে দেন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহা। হলকক্ষে তিন ঘণ্টা আটকে মারধর করা হয় তাঁকে। তাঁকে হুমকি দিয়ে বলা হয়েছিল, ‘কাউকে বললে আবরারের যে অবস্থা হয়েছে, সেই অবস্থা হবে।’

তদন্ত কমিটি হয়, প্রতিকার নেই

হলগুলোতে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য, সিট-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, মারধরের মতো ঘটনা নিয়মিত ঘটলেও কোনোটির ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ওপরের তিনটি ঘটনায় দ্রুতই তদন্ত কমিটি হয়েছে। কিন্তু একটিও প্রতিবেদন জমা পড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, করোনার পর অন্তত ২৩টি ঘটনায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী হল প্রাধ্যক্ষ, প্রক্টর দপ্তর ও ছাত্র-উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। সূত্র বলছে, এসব ঘটনায় ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণও পাওয়া গেছে। তবে একটি ঘটনায়ও ছাত্রলীগের কাউকে শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

আবাসিক হলে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের দখলদারত্ব, আসন-বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ করে আসছেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। বিভিন্ন সময় মানববন্ধন, প্রতীকী অনশনে বসেছেন। গত বছরের ২৬ জুন তিনি প্রশাসন ভবনের সামনে শামসুজ্জোহা চত্বরে নির্যাতনের বিরুদ্ধে অনশন করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেন, একের পর এক শিক্ষার্থী আক্রান্ত হচ্ছেন। তদন্ত কমিটিও হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো কখনো আলোর মুখ দেখছে না। এটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। প্রশাসনের অবশ্যই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিধি অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তা ছাড়া ক্যাম্পাসে এগুলো চলতেই থাকবে।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলছেন, তাঁরা অনেকগুলো বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছেন। সেগুলো শিগগিরই ডিসিপ্লিন কমিটিতে যাবে। এর মধ্যে অনেকেই অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তবে তিনিও মনে করেন, এ ধরনের ঘটনায় শাস্তি হলে হলগুলোতে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কমবে।

বৃহস্পতিবার যা ঘটেছে

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে শাহ্‌ মখদুম হলের শিক্ষার্থী সামিউল মারধরের শিকার হন। তিনি অভিযোগ করেন, বৃহস্পতিবার রাতে হল ছাত্রলীগের সভাপতি তাজবিউল হাসান ওরফে অপূর্ব তাঁর কাছে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। ছাত্রলীগের এই নেতা তাঁকে হুমকি দেন, সামিউল হলের যে কক্ষে উঠেছেন, সেই কক্ষে থাকতে হলে এই টাকা দিতে হবে। এই কথা কাউকে জানালে তাঁর লাশও পরিবার খুঁজে পাবে না। 

একপর্যায়ে সামিউলের মানিব্যাগে থাকা ৩ হাজার ৭৭৫ টাকা জোর করে ছিনিয়ে নেন তাজবিউল। তাঁর বাসায় ফোন দিয়ে বাকি টাকা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা করে বিকাশে দিতে বলেন। সামিউলের ভাষ্য অনুযায়ী, টাকা দিতে না পারায় তাজবিউল একপর্যায়ে তাঁকে মারধর শুরু করেন। এরপর তাজবিউলের অনুসারীরা তাঁকে মেঝেতে ফেলে এলোপাতাড়ি কিল, ঘুষি মারতে থাকেন। 

তবে তাজবিউল বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগ এসেছে, এটা মিথ্যা ও বানোয়াট। তিনি ওই কক্ষে যাননি। টাকাপয়সা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবে সামিউলের রুমমেট জানান, তাজবিউল বৃহস্পতিবার রাতে এসেছিলেন। এসে চড়-থাপ্পড়ও মেরেছেন।

এদিকে গতকাল দুপুরে ভুক্তভোগী ও অভিযুক্তকে আলাদা করে ডেকেছিল হল প্রশাসন। এ নিয়ে হলের আবাসিক শিক্ষকদের নিয়ে জরুরি সভাও করেছেন হল প্রাধ্যক্ষ মো. রুহুল আমিন। প্রাধ্যক্ষ সামিউলের কাছ থেকে একটি লিখিত অভিযোগ নিয়েছেন।

হল প্রাধ্যক্ষ মো. রুহুল আমিন বলেন, এ বিষয়ে হলে একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সামিউলের বাড়ি কুড়িগ্রামে। তিনি টিউশনি করে চলেন। বাবাহীন পরিবারকেও মাঝেমধ্যে খরচ পাঠাতে হয়। ছয় মাস আগে বৈধভাবে সামিউল হলের ২১৪ নম্বর কক্ষে ওঠেন। দুই মাস আগে তিনি সভাপতিকে তিন হাজার টাকা দিয়েছিলেন বলে জানান।