কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাতের সময় নারায়ণগঞ্জের ডিআইটি রোডে গুলিতে নিহত হয়েছে কিশোর মো. রাসেল (১৫)। ছেলের শোকে বাবা পিন্টু রহমান ও মা অঞ্জনা খাতুন মুষড়ে পড়েছেন। এই দম্পতির বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার কশব ইউনিয়নের ভোলাগাড়ী গ্রামে। রাসেলের এমন মৃত্যুতে স্বজন ও প্রতিবেশীরাও শোকাহত।
গতকাল শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভোলাগাড়ী গ্রামে রাসেলদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশ-খড়ের বেড়া আর টিনের ছাউনির ছোট্ট একটি ঘর। সেই ঘরেই রাসেলের পরিবারের সদস্যদের বসতি। বাড়িটির সামনে পৌঁছাতেই ভেতর থেকে নারীকণ্ঠে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে প্রতিবেশী এক নারী বাড়ির ভেতরে গিয়ে রাসেলের চাচা আবদুর রশিদকে ডেকে আনেন। বাড়ির বাইরে আলাপকালে আবদুর রশিদ বলেন, রাসেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শোনার পর থেকে তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মুখে কোনো দানাপানি নিচ্ছেন না। এতে তিনি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তাঁকে নিয়ে হাসপাতালে গেছেন রাসেলের বাবা।
আবদুর রশিদ বলেন, সংসারে অভাবের কারণে রাসেল দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে আর বিদ্যালয়ে যায়নি। দেড় বছর ধরে নারায়ণগঞ্জে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করছিল। ছয়-সাত হাজার টাকা বেতনের সেই চাকরি। গত কোরবানির ঈদের ছুটি শেষে নারায়ণগঞ্জে ফিরে যায় রাসেল। আর এবার সে বাড়িতে ফিরে এল লাশ হয়ে।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯ জুলাই বিকেলে নারায়ণগঞ্জের ডিআইটি রোডের দেওভোগ মার্কেটের ২ নম্বর গেটের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সেখানে গুলিবিদ্ধ হয় কিশোর মো. রাসেল। গুরুতর আহত অবস্থায় রাসেলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাসেলের বুকে একটি বুলেট বিদ্ধ হয়েছিল। ২১ জুলাই তার শরীরে অস্ত্রোপচার করে বুলেট বের করা হয়। পরে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২২ জুলাই (সোমবার) সে মারা যায়। ২৩ জুলাই দুপুরে তার লাশ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। পরে ওই দিনই লাশ দাফন করা হয়েছে।
নিহত রাসেলের বাবা পিন্টু রহমান দিনমজুরি করে সংসার চালান। চার ভাই–বোনের মধ্যে রাসেল সবার ছোট। তার এক বোন মানসিক প্রতিবন্ধী। বাড়ির বাইরে আবদুর রশিদের সঙ্গে কথা বলা অবস্থায় হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন নিহত রাসেলের বাবা পিন্টু রহমান ও মা অঞ্জনা খাতুন। রাসেলের বিষয়ে জানতে চাইলে পিন্টু রহমান ডুকরে কেঁদে বলেন, ‘ছেলের বুকে গুলি লাগছে শুক্রবার (১৯ জুলাই)। চার দিন ধরে হাসপাতালের বেডে কাঁতরাইছে। ছেলে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়োছে জ্যানেও তার পাশে থাকতে পারিনি। কতই না কষ্ট প্যায়ে মারা গেছে। কতই না আর্তনাদ করিছে। এমন কষ্ট আল্লাহ য্যান আর কাউকে না দেয়।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে পিন্টু রহমান বলেন, ১৯ জুলাই বিকেলে ছেলের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয়েছিল। ফোন করে তার মা ও বোনের খোঁজ নিয়েছে। ওই দিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাসেলের ফোন থেকে এক ব্যক্তি কল করে জানান যে রাসেল গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ঢাকা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এরই মধ্যে শোনেন, কারফিউ জারি হয়েছে। ঢাকা যাওয়ার কোনো গাড়ি না পাওয়ায় আর যেতে পারেননি।
রাসেলের বাবা একেবারে গরিব মানুষ। দিনমজুরি করে কোনো রকমে সংসার চালান।পাঞ্জব আলী, প্রতিবেশী
নিহত রাসেলের প্রতিবেশী ও কশব ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য পাঞ্জব আলী বলেন, রাসেলের বাবা একেবারে গরিব মানুষ। দিনমজুরি করে কোনো রকমে সংসার চালান। তিন মেয়ের মধ্যে একজন প্রতিবন্ধী। অন্য দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়ের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের কিছুদিন পরই স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এখন তিনি বাবার সংসারেই থাকেন। রাসেল ছেলেটা দেড় বছর ধরে পোশাক কারখানায় কাজ করছিল। ছয়-সাত হাজার টাকা বেতনে কোনো মতে তাদের সংসার চলছিল। আর কিছুদিন গেলে হয়তো কাজ ভালোভাবে শিখলে বেতন আরও বাড়ত। এরই মধ্যে সব শেষ হয়ে গেল।