রমা কান্ত রায়
রমা কান্ত রায়

বিরল উপজেলা নির্বাচন

স্কুলে না গিয়েও নেন বেতন–ভাতা, হলফনামায় সম্পদের তথ্য গোপন

বিদ্যালয়ের শরীরচর্চা শিক্ষক। এক দশক ধরে দায়িত্ব পালন করেন না। তবে নিয়মিত বেতন–ভাতা তোলেন। শিক্ষার্থীরা তাঁকে আওয়ামী লীগ নেতা কিংবা বিদ্যালয়ের পরিদর্শক হিসেবে চেনেন। তিনি অন্য তিনটি বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বের পাশাপাশি আরও কয়েকটি সংগঠনের নেতৃত্বে আছেন। এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

শিক্ষক-রাজনীতিবিদ-সংগঠক ওই ব্যক্তির নাম রমা কান্ত রায় (৫৫)। দিনাজপুরের বিরল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দ্বিতীয় ধাপে ২১ মে অনুষ্ঠেয় বিরল উপজেলা নির্বাচনে তিনি মোটরসাইকেল প্রতীক নিয়ে লড়ছেন।

গত এক দশকে ৬৫০ শতকেরও বেশি কৃষি ও অকৃষিজমির মালিক হয়েছেন রমা কান্ত। নগদ অর্থসহ ব্যাংকে জমা রেখেছেন প্রায় ৬০ লাখ টাকা। পৌর এলাকায় ১৬ শতক জমিতে নির্মাণ করছেন বহুতল ভবন। করদাতার পরিসম্পদ, দায় ও ব্যয় বিবরণীতে যেটির মূল্য দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। স্কুলে না গিয়ে বেতন উত্তোলন, নিয়োগ–বাণিজ্য ও জমি কেনার বিষয়ে তদন্ত চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে ২ মে অভিযোগ করেছেন এক ব্যক্তি। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে ঘুষ গ্রহণ, দলীয় প্রভাব ও একে-অপরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে জমি দখলের অভিযোগ করেন কয়েকজন ভুক্তভোগী।

এলাকাবাসী ও রাজনৈতিক সহকর্মীরা তাঁর বিরুদ্ধে নিয়োগ–বাণিজ্য, অর্থ আত্মসাৎ, অন্যের জমি দখল, বিদ্যালয়ে না গিয়ে বেতন–ভাতা উত্তোলনের নানা অভিযোগ করেছেন। তিনি নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় তাঁর সব সম্পদের তথ্য উল্লেখ করেননি। এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগও করা হয়েছে।

অভিযোগের ব্যাপারে রমা কান্ত রায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্কুলে যাই তো আমি।’ হলফনামায় সম্পদের তথ্য না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কাগজপত্র না দেখে বলতে পারব না। আপনি সাক্ষাতে আসেন।’ হলফনামার উল্লিখিত আয়ের উৎস জানতে চাইলে একইভাবে বলেন, ‘ওগুলো না দেখে বলা যাবে না।’

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল আজাদ বলেন, শিক্ষকতা করে যেখানে সংসার চালানো মুশকিল, সেখানে এত টাকার জমি কেনা, দেড় কোটি টাকার বাড়ি নির্মাণ কীভাবে সম্ভব? একেকজন পিয়ন নিয়োগে ৫ লাখ টাকা নিয়েছেন। একে-অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে জমি দখল করছেন। রাজনৈতিক কর্মী থেকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই তাঁর ভয়ে তটস্থ থাকেন। ১০ বছরে টাকার বিনিময়ে অন্তত ১০০ জনকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিলেই সব বেরিয়ে আসবে।

সম্পদের তথ্য গোপন

নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় রমা কান্ত রায় স্থাবর সম্পদ হিসেবে ১১৪ দশমিক ৫ শতাংশ কৃষিজমি, ১১৭ শতক অকৃষিজমি ও ১৬ শতক জমির ওপরে নির্মাণাধীন একটি বাড়ির কথা উল্লেখ করেছেন। স্ত্রী লিভা রানীর কৃষিজমি দেখিয়েছেন ১৫০ শতাংশ। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী দুজনের উপজেলার বেতুড়া মৌজায় মোট ৩৯৭ দশমিক ৫ শতাংশ স্থাবর সম্পদ আছে।

তবে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেতুড়া, দৈকতবাড়ী, বিরল ও গোপালপুর মৌজায় রমা কান্ত ও তাঁর স্ত্রীর মোট জমির পরিমাণ ৬৫০ শতকেরও বেশি। এ জমির অধিকাংশই তিনি ২০১৯ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর কিনেছেন।

দিনাজপুরের বিরল পৌর শহরের পাইকপাড়া এলাকায় চেয়ারম্যান প্রার্থী রমা কান্ত রায়ের ১৬ শতক জমিতে নির্মাণাধীন ভবন। ৩ মে তোলা

অস্থাবর সম্পদ হিসেবে রমা কান্তের কাছে নগদ ৫৭ লাখ ৭০ হাজার, ব্যাংকে জমা ২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা আছে। এ ছাড়া ৫৬ হাজার টাকা মূল্যের ৮ ভরি সোনা, ৭৫ হাজার টাকার ইলেকট্রনিকসামগ্রী, ৬৫ হাজার টাকার আসবাব থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। আয়ের উৎস হিসেবে রমা কান্ত রায় কৃষি খাত থেকে বার্ষিক ১ লাখ ২৫ হাজার, ব্যবসা ও ঠিকাদারি থেকে ১৪ লাখ ২৫ হাজার, শিক্ষকের সম্মানী হিসেবে ২ লাখ ২৬ হাজার ও অন্যান্য খাত থেকে তিনি ৩২ লাখ ২১ হাজার ৯০০ টাকা আয় দেখিয়েছেন। অন্যান্য খাতের আয় স্পষ্ট করেননি।

স্কুলে না গিয়েও নেন বেতন–ভাতা

রমা কান্ত উপজেলার হালজায় উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক। গত ১০ বছর তিনি বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেন না। প্রধান শিক্ষক হাজিরা খাতা বাসায় নিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে আনেন। বিদ্যালয় থেকে এবার ৮৯ জন এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হয়েছে ২৬ জন। বর্তমান শিক্ষার্থীদের কেউ রমা কান্তকে ক্লাসে পায়নি। তবে দেখেছেন, নামও শুনেছেন। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে নয়, বরং বিদ্যালয় পরিদর্শক বা আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে।

ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহাতাব উদ্দিন বলেন, ১০ বছরের বেশি সময় রমা কান্ত স্কুলে আসেন না। প্রধান শিক্ষক তাঁকে তোষামোদ করে চলেন। প্রতিবাদ করায় তাঁকে সদস্যপদ থেকে বাদ দিয়েছেন। তবে প্রধান শিক্ষক মলেশ চন্দ্র রায় দাবি করেন, রমা কান্ত রায় বিদ্যালয়ে আসেন, তবে কম।

রাজনীতিতে উত্থান যেভাবে

১৯৮৫ সালে বিরল উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতির পদ পান রমা কান্ত রায়। এরপর যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই যুগ আগেও পুরোনো একটি সাইকেলে গ্রাম থেকে শহরে যাতায়াত করতেন। ১৯৯৮ সালে হালজায় উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। পাশাপাশি রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছেন।

সর্বশেষ ২০১৯ সাল থেকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও পৌরসভা থেকে ‘মেসার্স কুইন ট্রেডার্স’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নিয়েছেন। পাশাপাশি রমা কান্ত রায় উপজেলার বেতুড়া উচ্চবিদ্যালয়, পাকুড়া উচ্চবিদ্যালয়, রামপুর উচ্চবিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি এবং বিরল মহিলা কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সদস্য।

নিয়োগ ও বদলি–বাণিজ্যের অভিযোগ

ভান্ডারা গ্রামের কৃষক ধীরেন্দ্রনাথ প্রথম আলোকে বলেন, ভান্ডারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরী পদে ছেলের চাকরির জন্য এক বিঘা বিক্রি ও তিন বিঘা বন্ধক রেখে রমা কান্ত ও মলেশ চন্দ্রকে ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। সাত বছর হয়ে গেল। চাকরিও নেই, টাকাও নেই। টাকা ফেরত চাইলে বলেন, ‘চাকরি হবে।’

বিরলের উত্তর বিষ্ণুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি–কাম–নৈশপ্রহরী পদে চাকরিপ্রত্যাশী ছিলেন কনেশ্বর শর্মা। তিনি বলেন, ‘রমা কান্ত রায়কে ৮ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়েছি। কিন্তু চাকরি হয়নি। পরে অনেক কষ্টে কিছু টাকা ফেরত পেয়েছি। সর্বশেষ ২ মে দুদকে অভিযোগ হওয়ার পরদিন এক আওয়ামী লীগ নেতার মারফত তিনি বাকি টাকা ফেরত দিয়েছেন।’