কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাটের সন্দ্বীপ প্রান্তের জেটি। গত ২২ অক্টোবর তোলা
কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাটের সন্দ্বীপ প্রান্তের জেটি। গত ২২ অক্টোবর তোলা

চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ নৌপথের ঘাট নিয়ে দুই সংস্থার দ্বন্দ্বে দুর্ভোগে যাত্রীরা

চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ যাতায়াতের প্রধান নৌপথ কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাটের মালিক কে—এমন প্রশ্নের উত্তর মেলেনি দুই যুগেও। ঘাট নিয়ে জেলা পরিষদ ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) মালিকানার দ্বন্দ্বে যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। জেলা পরিষদ একক প্রতিষ্ঠানকে ঘাটের ইজারা দেওয়ায় ইজারাদারের খেয়ালখুশিমতো নৌযান পরিচালনা করা হয়। এতে জরুরি প্রয়োজনে যাঁরা পারাপার হতে চান তাঁরা দুর্ভোগের শিকার হন।

অপর দিকে সম্প্রতি বিআইডব্লিউটিএ আগ্রহী যেকোনো ব্যক্তি যাত্রীবাহী নৌযান পরিচালনা করতে পারবে বলে ঘোষণা দেয়। এতে জেলা পরিষদের সঙ্গে নতুন করে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৯ সাল থেকে জেলা পরিষদ কুমিরা–গুপ্তছড়া ঘাটের ইজারা দিয়ে আসছে। তবে ২০০৯ সালে ঘাটের মালিকানা দাবি করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এর পর থেকে এই দুই প্রতিষ্ঠানের মালিকানার দ্বন্দ্ব চলমান। উভয় সংস্থাই একে অপরকে অবৈধ বলছে। ফলে এই ঘাটে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নৌপরিবহন ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে যাত্রী পরিবহনে প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানও নেই এখানে। ফলে অতিরিক্ত ভাড়া ও নৌযান স্বল্পতার সমস্যা দূর হচ্ছে না।

ঘাটের বর্তমান একক ইজারাদার জগলুল হাসান প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ এবং বিআইডব্লিউটিএ উভয় প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি ইজারা নিয়েছেন। বর্তমানে ১০টি স্পিডবোট দিয়ে যাত্রী পারাপার করছেন। ইজারার শর্ত অনুযায়ী জেলা পরিষদকে প্রতিদিন ৯৩ হাজার টাকা এবং বিআইডব্লিউটিএকে বছরে ৮৪ লাখ টাকা পরিশোধ করছেন। এই নিয়মে স্পিডবোট চালিয়ে তাঁকে লোকসান গুনতে হচ্ছে।

একক ইজারা ও উন্মুক্ত ইজারা

চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের বিধি অনুযায়ী, যেকোনো একটি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি শর্ত পূরণ করে ঘাটের ইজারা নিতে পারে। ইজারার মেয়াদকালে তাই একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকে ওই একজন ইজারাদারেরই। জেলা পরিষদের এই ইজারাকে তাই ‘একক ইজারা’ বলা হয়।

অন্যদিকে ‘বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন বিধিমালা ২০১৯’ অনুযায়ী, নির্ধারিত শর্ত মেনে ও অর্থ পরিশোধ করে যে কেউ যেকোনো ঘাটে যাত্রীবাহী বোট পরিচালনা করতে পারবেন। এতে একক নিয়ন্ত্রণের বদলে বহুজনের অংশগ্রহণে ঘাট পরিচালনার জন্য উন্মুক্ত থাকে। ফলে এই প্রথাটি ‘উন্মুক্ত ইজারা’ নামে পরিচিত।

গত ২২ আগস্ট কুমিরা ঘাটে বিআইডব্লিউটিএ এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধিদল যাত্রী, বোটমালিক ও চালকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে উন্মুক্ত ইজারার ঘোষণা দেন। এ দিন স্পিডবোটের ভাড়া ৩৮০ টাকা থেকে কমিয়ে ২৫০ টাকা আদায়ের নির্দেশ দেন কর্মকর্তারা। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাটে যাত্রীবাহী বোট পরিচালনায় আগ্রহীদের কাছ থেকে সার্ভে রেজিস্ট্রেশন ও রুট পারমিটের আবেদনপত্র আহ্বান করে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে।

উন্মুক্ত ইজারার দাবি যাত্রীদেরও

এই পথে চলাচল করা যাত্রীদের দাবি—মালিকানা যে প্রতিষ্ঠানেরই হোক না কেন, তাঁদের দুর্ভোগ দূর করার স্বার্থে ঘাটের ইজারা উন্মুক্ত করে দিতে হবে। কয়েকজন যাত্রী প্রথম আলোকে জানান, ঘাটে পৌঁছে প্রায়ই তাঁদের দেড়-দুই ঘণ্টা পর্যন্ত স্পিডবোটের অপেক্ষায় থাকতে হয়। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও টিকিট পান না। একক ইজারার সুযোগ নিয়ে যখন-তখন বোট চলাচল সীমিত রেখে সীমাহীন দুর্ভোগে ফেলা হচ্ছে তাঁদের। উন্মুক্ত ইজারায় বোটমালিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকলে এই স্বেচ্ছাচারিতার অবসান ঘটতে পারে বলে মনে করেন যাত্রীরা। তবে চলাচল সীমিত করার বিষয়টি অস্বীকার করেন ইজারাদার জগলুল হাসান।

গুপ্তছড়া (সন্দ্বীপ) ঘাটে অপেক্ষমাণ যাত্রী সাইফুল ইসলাম (৪৮) প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক ঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করছি। আবহাওয়া খুব ভালো কিন্তু বোট ছাড়ছে না। জোয়ারের সময় সার্ভিস বোট আর মালের বোটে যাত্রী পার করার জন্য স্পিডবোট বন্ধ করে রেখেছে। ইজারা একজনের হাতে থাকায় এ রকম সমস্যা হয়। অনেক ব্যবসায়ী থাকলে কারও না কারও বোট পাওয়া যাবে।’

সফিকুল ইসলাম (৫২) নামের এক যাত্রী বলেন, ‘২০ অক্টোবর আমার অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে ঘাটে এসে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেও স্পিডবোটে যেতে পারিনি। পরে মালের বোটে করে চট্টগ্রাম গেছি।’

গত শনিবার চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপে ফেরা যাত্রী মো. তালিম হোসেন বলেন, ‘ঘাট কীভাবে কারা চালাবে সে বিষয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। আমাদের চাওয়া ন্যায্য ভাড়ায় সময়মতো নিরাপদে সাগর পারাপার।’

যে কারণে উন্মুক্ত ইজারা কার্যকর হচ্ছে না

উন্মুক্ত ইজারার বিজ্ঞপ্তির পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সন্দ্বীপ মেরিন সার্ভিস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান ১০টি স্পিডবোট দিয়ে কম ভাড়ায় যাত্রীসেবার কাজ শুরু করার ঘোষণা দেয়। সূত্র জানায়, সরকারি দুই প্রতিষ্ঠানের রশি টানাটানিতে প্রতিষ্ঠানটি ইজারা নিতে আগ্রহ হারিয়েছে।

এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক (পোর্ট অফিসার) মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, অনুমোদন নিয়ে যে কেউ ঘাটে বোট পরিচালনা করতে পারবেন। তাঁরা দায়িত্ব নিয়ে চলাচলের ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত সময় পেরিয়ে গেলেও বোট পরিচালনার অনুমোদনের জন্য (উন্মুক্ত ইজারা) কেউ আবেদন করেননি।

তবে জেলা পরিষদের বিধি অনুযায়ী উন্মুক্ত ইজারার সুযোগ নেই বলে জানান চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী সাব্বির ইকবাল।

কে বৈধ আর কে অবৈধ

বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক (পোর্ট অফিসার) মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ঘাট জেলা পরিষদের ইজারা দেওয়ার কোনো এখতিয়ারই নেই। ডিজি শিপিং বোটের সার্ভে রেজিস্ট্রেশন করবে। আমরা (বিআইডব্লিউটিএ) রুট পারমিট দেব। জেলা পরিষদ যদি এসব করে তাহলে তারা সরকারি বিধি লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবে।’

তবে নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের এমন দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী সাব্বির ইকবাল। তিনি নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের দাবিকে অযৌক্তিক, ভিত্তিহীন ও অবৈধ বলে দাবি করে বলেন, ‘এই ঘাটের মালিক চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ। বিআইডব্লিউটিএর ইজারা দেওয়ার বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টার কোনো আইনি ভিত্তি নেই।’