বছরের সাত-আট মাস গ্রামের চারপাশে থাকে পানি। পানিতে কখনো কখনো প্লাবিত হয় ঘরের উঠান।
বছরের বড় একটা সময় আর কিছু নয়, জলই তার প্রাণ। চারপাশে থই থই করা হাওরের ভাসান পানি, আছড়ে পড়া ঢেউয়ের চঞ্চলতা, উচ্ছ্বাস ও দুরন্তপনা গ্রামটিকে ছুঁয়ে থাকে। এই একটা জলবতী সময়ে গ্রামের বাড়িগুলো ছোট ছোট দ্বীপ হয়ে যায়। গ্রামের নাম অন্তেহরি, জলের গ্রাম। কাউয়াদীঘি হাওরের এক আদুরে কন্যাই সে। হাওরের বুক ঘেঁষে প্রকৃতিতেই মিলেমিশে আছে।
গ্রামের ভেতরটিতে মানুষের জীবনযাত্রা যে রকমই থাক—হিজল, করচ, বরুণ, জারুলসহ নানা জাতের জলজ উদ্ভিদের জলাবন গ্রামটিকে নিবিড় বাহুতে জড়িয়ে আছে, আগলে রেখেছে। এখানে শীত-বর্ষায় অনেক বৈচিত্র্য, মুগ্ধ করা নানা চেহারা। হাওরজুড়ে জলের বুকে ছবি আঁকে সকালবেলার সূর্য, রোদের রুপালি ঝিলিক, সাদা-কালো মেঘ, পাল তোলা ডিঙি, জেলে নৌকা, সূর্য ডোবার রং। শাপলা-শালুক, মাছের ঘাই—তারা তো আছেই।
কাউয়াদীঘি মৌলভীবাজারের অন্যতম একটি হাওর। মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগরে পড়েছে হাওরটির অবস্থান। হাওরের বেশির ভাগ অংশই পড়েছে রাজনগরে। এই রাজনগর অংশের ফতেহপুর ইউনিয়নে ঝড়-জলের প্রতিবেশী হয়েই আছে জলের গ্রাম অন্তেহরি। হাওর মানেই বর্ষায় বুকভরা পানির সাম্রাজ্য। শীতে মাইল মাইল খোলা দিগন্ত। বর্ষাকালে কাউয়াদীঘি হাওরের বুকের কাছে ঘন সবুজ রেখার মতো গ্রামটিকে দূর থেকে মনে হয়, অনেকটাই পানির ওপর ভাসছে। আসলে ওটা ভাসমান একটি গ্রামই। বছরের সাত-আট মাস গ্রামটি ঘিরে থাকে কাউয়াদীঘি হাওরের পানি। পানি বাড়লে কখনো কখনো কারও উঠান ভাসে, ছুঁয়ে যায় ঘরও। পথঘাট তো আগেই ডুবে। সেই কবে এখানে যারা এসে ঘর বেঁধেছে, তারা পানিকে ভালোবেসেই হয়তো বসতি গড়েছিল। এ-তো পানির সঙ্গেই আরশি-পড়শির দিন কাটানো। গ্রামের প্রতিটি বাড়িই ঘিরে আছে হিজল-করচ। হিজল-করচের ঢেউখেলানো ডালপালা প্রতিটি বাড়িকে যেন মমতায় আগলে রাখে। গ্রামের এদিক-ওদিক তাকালেই দেখা যাবে, ছোট ছোট জলাবন। বর্ষায় কোমর, বুকসমান পানিতে ডুবে দাঁড়িয়ে থাকে বনের গাছ। হাওরের উত্তাল ঢেউ আঁচড়ে পড়ে জলাবনে। সাদা-রঙিন মেঘ জলের ভাঁজে ভাঁজে ডুবসাঁতার খেলে। সন্ধ্যায় জলাবন ও গ্রামের দিকে ফিরে আসে সাদা বকের ঝাঁক, পানকৌড়ি। শাপলা-শালুকের দল কেটে ছোট ডিঙি ছুটতে থাকে। কেউ যায় মাছ ধরতে, কেউ যায় এবাড়ি-ওবাড়ি, কেউ হয়তো হাটের দিকে। কেউবা করে খেয়া পারাপার। সন্ধ্যার আকাশে মেঘদল মুহূর্তে মুহূর্তে রং বদলালে শুধু অন্তেহরিতেই না, হাওরপাড়ের সব গ্রাম ও হাওরের জলে তার ছোঁয়া লাগে। পশ্চিমে সূর্যটা গাছের মাথায় লাল টুকটুকে থালার মতো ঝুলে থাকে কিছু সময়। যেন টোকা লাগলেই টুপ করে ডুবে যাবে অমরাবতীর ওপারে। শেষ বেলার সেই লাল রং কাউয়াদীঘির পানিতে মিলেমিশে একসময় ঝুপ করে অন্ধকার নামে। তখন হয়তো ছোপ ছোপ বইঠার কিছু শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না।
শীত মৌসুমেও কাউয়াদীঘি হাওর, হাওরকন্যা অন্তেহরির রূপের কোনো কমতি হয় না। পাতাঝরার কালেও সবুজ হারিয়ে যায় না হিজল-করচ থেকে। যত দূর চোখ যায়, খোলা দিগন্তে থাকে সবুজের মাঠ। পরিযায়ী পাখির ঝাঁক মালার মতো উড়তে থাকে। বিলে-ঝিলে নামে। গ্রামের গাছে গাছে রাত কাটায়। রাখালের দল গরু-মোষের পাল নিয়ে ছুটে হাওরের বুকে। এই সময় চাষিদের ধান রোপণ, ধান তোলার মৌসুম। অন্য এক মায়া তখন হাওরজুড়ে, হাওরপাড়ে।
অনেক পর্যটক এই হাওরকন্যার কাছে একটুখানি মুক্তির শ্বাস নিতে ছুটে আসে। হাওরের বাতাস নিঃশব্দে ছুঁয়ে যায় তাঁদের। জেলা প্রশাসন থেকেও সেখানে দুটি নৌকা দেওয়া আছে। তবে মৌলভীবাজার-অন্তেহরি সড়কের কাদিপুর-অন্তেহরি অংশের প্রায় এক-দেড় কিলোমিটার সড়ক ভাঙাচোরা। তাই তো আজ মঙ্গলবার বিশ্ব পর্যটন দিবসে সড়কটি সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি মৌলভীবাজার সদর উপজেলা কমিটির সম্পাদক রাজন আহমদ গতকাল সোমবার বলেন, ‘আমাদের দেশে ছোট-বড় হাওরকে কেন্দ্র করে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই গড়ে উঠছে পর্যটনকেন্দ্র। কিন্তু এই পর্যটনকেন্দ্রের বিকাশে প্রকৃতি-পরিবেশবান্ধব কোনো প্রকল্প পরিকল্পনা দেখি না।’
জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান গত রোববার বলেন, ‘এলাকাটিকে আরও আকর্ষণীয় করতে গ্রামের আশপাশের ঘরগুলোকে একই রকম রং করে দেওয়াসহ কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এক বছর আগে এ রকম একটি পরিকল্পনা পর্যটন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। প্রকল্পটি ওইভাবেই আছে। সড়কটির বিষয়েও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছি।’