গত বুধবার ছাত্রলীগের ৬ নেতা–কর্মীকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপরই অনলাইন জুয়ার বিষয়টি সামনে আসে।
রাশিয়ায় পড়াশোনা করতে যাওয়ার পর সে দেশের ক্যাসিনো ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে বাংলাদেশি দুই তরুণের। ক্যাসিনোমালিকদের সহায়তায় মুঠোফোনে জুয়ার অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করে চট্টগ্রাম ও নরসিংদীতে এজেন্ট নিয়োগ দেন তাঁরা। এসব এজেন্টের হাত ধরে মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর গ্রামে গড়ে ওঠে অনলাইন জুয়ার বড় একটি চক্র।
সম্প্রতি পুলিশের সাইবার অপরাধ তদন্ত দল মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত ৩২ জনকে আটক করে। গত বুধবার ছাত্রলীগের দুই নেতা ও তাঁদের চার কর্মীকে এই অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপরই সামনে আসে অনলাইন জুয়ার আদ্যোপান্ত।
জেলা পুলিশের সাইবার অপরাধ তদন্ত দলের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, অনলাইন জুয়া ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন মেহেরপুরের দুই শতাধিক তরুণ। এসব তরুণ মূলত মুঠোফোনের নম্বর ব্যবহার করে টাকা লেনদেন করেন। তবে জুয়া খেলায় দেশের কত মানুষ জড়িত, সে সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।
অনলাইন জুয়া ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন মেহেরপুরের দুই শতাধিক তরুণ। এসব তরুণ মূলত মুঠোফোনের নম্বর ব্যবহার করে টাকা লেনদেন করেন।মনিরুল ইসলাম, মেহেরপুর পুলিশের সাইবার অপরাধ তদন্ত দলের প্রধান
পুলিশ ও জুয়াড়িদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনলাইনে জুয়া খেলার দুই শতাধিক অ্যাপ আছে। তিনপাত্তি, লাইভ ক্যাসিনো, ক্রিকেট, ফুটবলসহ বেশ কয়েকটি মুঠোফোন অ্যাপ্লিকেশনে জুয়া খেলা হয়। আগ্রহী ব্যক্তিরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়ার অ্যাপ্লিকেশনে দেওয়া মুঠোফোন নম্বরে টাকা পাঠিয়ে ডলার কেনেন। লাইভ ক্যাসিনোতে ডলার দিয়ে ভার্চ্যুয়াল ক্যাসিনো চিপস কিনতে হয়। মূলত জুয়ার গ্রাহকেরা বাংলাদেশি টাকা দিয়ে ডলার কিনতে এজেন্টদের শরণাপন্ন হন। প্রতিটি জুয়া অ্যাপ্লিকেশনে একাধিক এজেন্ট থাকেন। তাঁদের কাজ হলো দুবাই থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা দিয়ে ডলার কেনা। পরবর্তীতে কয়েকটি ধাপে ডলার রূপান্তরিত হয় রাশিয়ান মুদ্রা রুবলে, যা পৌঁছায় রাশিয়ায় অবস্থান করা জুয়ার হোতাদের কাছে। পুরো প্রক্রিয়াটি ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে এড়িয়ে করা হয়।
বিটিআরসি বলেছে, অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে অপরাধী চক্র দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার করছে। মোবাইল অ্যাপ ছাড়াও অপরাধীরা বিভিন্ন ওয়েবসাইট বা ডোমেইনের মাধ্যমে সরাসরি অনলাইন গেম বা জুয়ায় অংশগ্রহণ করেন। এ জন্য দেশে ও বিদেশে থাকা বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রথমে অ্যাকাউন্ট খুলে নিবন্ধন করা হয়। তারপর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কার্ড বা অন্য কোনো মাধ্যমে জমা দিয়ে জুয়ায় অংশ নিতে হয়।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ অক্টোবর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক থেকে ৩৩১টি জুয়ার সাইট বন্ধ করে দিয়েছে বিটিআরসি। জুয়া বা বাজিসংক্রান্ত ১৫০টি অ্যাপ বন্ধের জন্য রিপোর্ট করা হলে গুগল কর্তৃপক্ষ প্লে স্টোর থেকে ১৪টি অ্যাপ বন্ধ করেছে। বাকিগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ফেসবুক ও ইউটিউবের মাধ্যমে জুয়া খেলার ওয়েবসাইট ও গুগল অ্যাপের প্রচার এবং অনলাইন জুয়াসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেয়, এমন ২৭টি ফেসবুক লিংক এবং ৬৯টি ইউটিউব লিংক বন্ধের জন্য রিপোর্ট করেছে বিটিআরসি। এর মধ্যে ১৭টি ফেসবুক লিংক ও ১৭টি ইউটিউব লিংক বন্ধ করা হয়েছে এবং বাকি লিংক বন্ধের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।
মেহেরপুর থেকে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে সম্প্রতি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি শাহিদুজ্জামান, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের গাংনী উপজেলা শাখার সভাপতি রবিউল ইসলাম, সাবেক ছাত্রনেতা জুবায়ের হোসেন, বিপুল হোসেন, চঞ্চল হোসেন, জিয়াউর রহমান, মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর গ্রামের নিমাই হালদার, প্রসেনজিৎ হালদার (২৫), সুমন আলী (৪০), মাহফুজুর রহমান নবাব (২৮), সাদ্দাম হোসেন (৩০), মোস্তাফিজুর রহমান সুমন, নুরুজ্জামান, মুকুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম, মাদার আলী, গোপালপুর দক্ষিণপাড়া এলাকার বদরুদ্দোজা রয়েল (৩৬), পলাশ ও শামীম রেজা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর গ্রামের বাসিন্দা বদরুদ্দোজা রয়েলকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য। তাঁরা ২৩০টি জুয়ার অ্যাপের এজেন্ট পরিচালনা করে আসছিলেন। প্রতিটি হিসাবের লেনদেনের জন্য এজেন্ট হিসেবে ৯ শতাংশ কমিশন পেতেন তাঁরা। এই কারণে এই জেলায় এজেন্টের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
মেহেরপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামিরুল ইসলাম বলেন, পুলিশের একাধিক টিম অনলাইন জুয়ায় যুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরও নাম পাওয়া গেছে এসব জুয়াতে।