কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বে দুই ভাগে বিভক্ত বিএনপির নেতা-কর্মীরা পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করছেন।
অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে পটুয়াখালীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত। জেলা আওয়ামী লীগের বিরোধ কিছুটা ভেতরে ভেতরে থাকলেও বিএনপির বিরোধ প্রকাশ্য। জেলা আওয়ামী লীগের কোন্দল ছড়িয়েছে উপজেলায়ও। এর মধ্যে দলের নেতারা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গণসংযোগ চালাচ্ছেন। সরকারের উন্নয়নের কথা বলছেন।
অন্যদিকে কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বে দুই ভাগে বিভক্ত বিএনপির নেতা-কর্মীরা পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করছেন। তাঁরা নির্বাচনের চেয়ে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পটুয়াখালী পৌরসভা নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে যান তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কাজী আলমগীর। একই বছরের ২ ডিসেম্বর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে কাজী আলমগীরকে সভাপতি মনোনীত করার পর রাখঢাক না রেখেই তিনি বলেছিলেন, দলে ঘাপটি মেরে থাকা বেইমানদের কারণে তিনি জিততে পারেননি।
অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে ২০২২ সালে জেলা পরিষদ নির্বাচনেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে যান নৌকার প্রার্থী। ওই সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক হন পটুয়াখালী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সহসভাপতি (ভিপি) আবদুল মান্নান।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আলমগীর বলেন, ‘তৎকালীন (পৌর নির্বাচন) প্রেক্ষাপট ও বর্তমান প্রেক্ষাপট এক নয়। এখন একটু পরিবর্তন আসছে। পৌর নির্বাচনের ত্রুটিবিচ্যুতি যাতে ভবিষ্যতে না হয়, সে জন্য কাজ করছি। অতীতের ভুল জাতীয় নির্বাচনে করবেন না নেতা-কর্মীরা।’
পটুয়াখালী-১ (সদর-মির্জাগঞ্জ-দুমকি) আসনের সংসদ সদস্য মো. শাহজাহান মিয়া ২১ অক্টোবর মারা গেছেন। গতকাল এই আসনের উপনির্বাচনের তফসিলও ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। এখানে মনোনয়নপ্রত্যাশী কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন, প্রয়াত শাহজাহান মিয়ার ছেলে তারিকুজ্জামান, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সুলতান আহমেদ মৃধা, সদস্য হারুন-অর-রশীদ হাওলাদার, আওয়ামী লীগের শ্রম ও জনশক্তিবিষয়ক উপকমিটির সদস্য মোহাম্মদ আলী আশরাফ, অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য রাজীব পারভেজ।
আফজাল হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ। বিশাল এ সংগঠনে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে দলের সিদ্ধান্ত সামনে রেখে দলের সব নেতা-কর্মী ঐক্যবদ্ধ। নৌকার প্রশ্নে আমরা এক ও অভিন্ন।’
পটুয়াখালী-২ (বাউফল) আসনে আওয়ামী লীগ তিন ভাগে বিভক্ত। সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব হাওলাদার এবং জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জিয়াউল হকের মধ্যে কোন্দল। তিন পক্ষের অনুসারী নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। তাঁরা ছাড়া আরও কয়েকজন নেতা এখানে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।
মোতালেব হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটিকে আমি দলীয় কোন্দল বলব না। নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা বলব। তবে দল যাকে মনোনয়ন দেবে, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকার পক্ষে নেমে প্রার্থীকে জয়লাভ করাব।’
পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা ও দশমিনা) আসনে সংসদ সদস্য এস এম শাহজাদা ও গলাচিপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সন্তোষ কুমার দের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। তাঁরা দুজনই দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। এ আসনে জেলার সভাপতি কাজী আলমগীর, উপজেলা আওয়ামী লীগের তথ্যপ্রযুক্তি সম্পাদক আ স ম জাওয়াদ, বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আবুল হোসেন দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। এ ছাড়া দশমিনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ. আজিজ মিয়া, সাধারণ সম্পাদক ইকবাল মাহমুদ মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
সংসদ সদস্য এস এম শাহজাদা ও সন্তোষ কুমার দে দুজনই একই সুরে বলেন, দলে এখনো কোনো বিরোধ নেই। মনোনয়ন নিয়ে প্রতিযোগিতা আছে। মনোনয়ন চূড়ান্ত হলে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামবেন।
পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) আসনে আওয়ামী লীগের কোন্দল প্রকাশ্য। সংসদ সদস্য মো. মহিববুর রহমান এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও কলাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মাহবুবুর রহমানের পক্ষের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। একে অপরের বিরুদ্ধে ‘রাতের ভোটের এমপি’ বলে কথাও ছড়ানো হয়।
জানতে চাইলে মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলীয় মনোনয়ন নিয়ে প্রতিযোগিতা আছে। এটা বিরোধ নয়।’ সংসদ সদস্য মহিবুবুর রহমান বলেন, বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করায় উপজেলা ও জেলা আওয়ামী লীগ থেকে মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রে চিঠি দেওয়া হয়েছে। দলে এখন সাংগঠনিক বিরোধ নেই।
জেলা বিএনপির পুরোনো বিরোধ এখন আরও তীব্র হয়েছে। বর্তমানে আহ্বায়ক কমিটি দিয়েই চলছে কার্যক্রম। কমিটি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা অভিযোগ আছে। পৃথক দলীয় কর্মসূচি পালনের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালে আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে সভাপতি ও স্নেহাংশু সরকার কুট্টিকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা বিএনপির কমিটি গঠন করার পর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে প্রথমে বিরোধ দেখা দেয়। ২০০৯ সালে আহ্বায়ক কমিটিতে স্নেহাংশু সরকারের জায়গা হয়নি। এরপর ২০১১ সালে আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে সভাপতি এবং এম এ রব মিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। স্থান হয়নি স্নেহাংশু সরকারের।
সর্বশেষ ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর জেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত করে আবদুর রশিদ ওরফে চুন্নু মিয়াকে আহ্বায়ক ও স্নেহাংশু সরকারকে সদস্যসচিব করে ৩১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। কমিটি ঘোষণার পর নেতা-কর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। এক পক্ষের অভিযোগ, দীর্ঘদিনের রাজপথের নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে নব্য বিএনপির লোকজনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
চলতি বছর দুই পক্ষ পৃথকভাবে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেছে। এ ছাড়া গত ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল বিভাগীয় রোডমার্চে বিএনপি পৃথক দুই জায়গা থেকে রোডমার্চে অংশ নেয়।
বিএনপির পুরোনো বিরোধের সময় আলতাফ চৌধুরীর সমর্থক ছিলেন মাকসুদ আহমেদ ওরফে বায়েজীদ পান্না। বর্তমান কমিটির ৩ নম্বর সদস্য তিনি। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর ইউনিয়ন ও থানা কমিটি ভেঙে দিয়ে দলে যাঁদের গ্রহণযোগ্যতা নেই, তাঁদের নিয়ে কমিটি করা হয়েছে।
আলতাফ হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সংগঠনের পুরোনো ও ত্যাগী নেতা-কর্মীদের একাংশ আহ্বায়ক কমিটিতে জায়গা পায়নি। তিন মাসের আহ্বায়ক কমিটি দুই বছর পার করে দিয়েছে, এখনো পূর্ণাঙ্গ হয়নি। ফলে দলে ঐক্যের অভাব আছে। তিনি বলেন, দলে স্বাধীনতাবিরোধী ও সুবিধাভোগীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এ কারণে পুরোনো ত্যাগী নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ। দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে কেন্দ্রীয়ভাবে কার্যক্রম চলছে।
দলীয় সূত্র জানায়, আহ্বায়ক কমিটির পর জেলার আটটি উপজেলার মধ্যে সাতটি উপজেলা ও পাঁচটি পৌরসভা ও একটি সাংগঠনিক থানা মহিপুরে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই সব কমিটির অধিকাংশই স্নেহাংশু সরকারের অনুসারী। আলতাফ হোসেন চৌধুরীর সমর্থক নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগ আছে। জেলা বিএনপির মতো উপজেলার নেতা-কর্মীরাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেন।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মজিবুর রহমান বলেন, ১৩টি ইউনিটে সম্মেলন করে তৃণমূলের ভোটের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগ সঠিক নয়। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের পর জেলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এক হাজারের মতো এজাহারভুক্ত আসামি, অজ্ঞাতনামা দুই হাজারের বেশি।
বিরোধের বিষয়টি মানতে নারাজ স্নেহাংশু সরকার। তিনি বলেন, দলে পদ-পদবি নিয়ে প্রতিযোগিতা আছে, কিন্তু বিরোধ নেই। আগে জেলা বিএনপির আন্দোলন-কর্মসূচি ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আহ্বায়ক কমিটি হওয়ার পর আন্দোলন-সংগ্রাম রাজপথে এসেছে। নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। তিনি কারও নাম উল্লেখ না করে বলেন, ‘আজকে যাঁদের ডাকা হয় না বলেন কিংবা নব্য বিএনপি বলে অভিযোগ করেন, তাঁরা আসলে একজনের পেছনে রাজনীতি করেন। তাঁরা আন্দোলনেও আসেন না, হামলা-মামলারও শিকার হন না। আমি মনে করি, জেলা বিএনপি এখন আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ।’
জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে সরকারের পদত্যাগের এক দফার আন্দোলনে মনোযোগ দিচ্ছে বিএনপি। নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ এখনো নিশ্চিত নয়। নির্বাচনে অংশ নিলে পটুয়াখালী-১ আসনে দলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী, জেলা বিএনপির সদস্যসচিব স্নেহাংশু সরকার ও সদস্য মাকসুদ আহমেদ মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া পটুয়াখালী-২ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য শহিদুল আলম তালুকদার ও বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক মুনির হোসেন, পটুয়াখালী-৩ আসনে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হাসান মামুন ও বিএনপির নেতা গোলাম মাওলা, পটুয়াখালী-৪ আসনে কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক এ বি এম মোশারফ হোসেন ও কলাপাড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক মো. মনিরুজ্জামান মনোনয়ন চাইবেন।