ভৈরব নদের বেশির ভাগ এলাকা এখন স্রোতহীন, প্রাণহীন। যশোরের দড়াটানা সেতু এলাকায় গতকাল বিকেলে
ভৈরব নদের বেশির ভাগ এলাকা এখন স্রোতহীন, প্রাণহীন। যশোরের দড়াটানা সেতু এলাকায় গতকাল বিকেলে

২৭৯ কোটি টাকা ব্যয়, প্রবাহ ফেরেনি ভৈরব নদে

যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার বাগডাঙ্গা গ্রামের সুমন সরকারের (৩৪) বাড়ি ভৈরব নদের পারে। দীর্ঘদিন ধরেই নদে জাল পেতে মাছ ধরেন তিনি। সুমন বলছিলেন, দুই বছর আগে নদটি খননের সময় মাঝখানে ঠিকমতো খনন করা হয়নি। নদের দুপাশে পানি বেশি, মাঝখানে কম। নদের ওপর থাকা সেতুগুলোর পাশের মাটি কাটা হয়নি। খননের আগে আফ্রা ঘাট থেকে ছাতিয়ানতলা পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকায় প্রবল জোয়ার উঠত। এখনো জোয়ার ওঠে। তবে গতি বেশ কম।

ভৈরব নদের বেশির ভাগ এলাকা এখন স্রোতহীন, প্রাণহীন। নদে নৌযান চলাচল ও প্রবহমানতা সৃষ্টির জন্য সরকারি প্রকল্পের খননকাজ শেষ হয়েছে গত বছরের জুনে। নদের ওপর অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ৫২টি সেতু রেখেই এই খননকাজ করা হয়েছে। নদটির পারের মানুষেরা বলছেন, খননে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেও নদ দিয়ে পানি গড়াল না।

পাউবো, নদটির পারের বাসিন্দা, নদী ও পরিবেশ আন্দোলনকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভৈরবের ওপর থাকা প্রায় সব সেতুর দৈর্ঘ্য ১৬ দশমিক ৪ থেকে ১২০ ফুটের মধ্যে। কেবল একটি সেতুর দৈর্ঘ্য ১৭৭ দশমিক ১১২ ফুট। অথচ নদের প্রশস্ততা ১৫০ থেকে ২৫০ ফুট।

ভৈরব নদে নৌযোগাযোগ স্থাপন ও জোয়ার–ভাটার প্রবাহ নির্বিঘ্ন করতে সরু সেতু সম্প্রসারণের অনুরোধ জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এ জন্য পাউবোর পক্ষ থেকে নদের সেতু–সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

তীরে গড়ে ওঠা স্থাপনার বর্জ্য সরাসরি পাইপলাইনের মাধ্যমে ভৈরব নদে ফেলা হচ্ছে। এতে নদের পানি দূষিত হচ্ছে। যশোর শহরের ঘোপ এলাকায়

পাউবো যশোর কার্যালয় সূত্র জানায়, ২৭২ কোটি ৮১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা ব্যয়ে পাঁচ বছরব্যাপী ‘ভৈরব রিভার বেসিন এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্পের’ কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ১ জুলাই। পরে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন করা হয়। প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে হয় ২৭৯ কোটি ১২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। 

প্রকল্পের আওতায় যশোরের চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুর থেকে সদর উপজেলার বসুন্দিয়া পর্যন্ত ৯২ কিলোমিটার নদ পুনঃখনন করা হয়েছে। এ ছাড়া বসুন্দিয়া থেকে আফ্রা ঘাট পর্যন্ত চার কিলোমিটার নদ ড্রেজিং করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র ভৈরব নদের তীরে ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০০ মিটার এলাকা সৌন্দর্যবর্ধনের কাজও করা হয়েছে। কিন্তু নদের ওপর নির্মিত ৫২টি অপরিকল্পিত সেতু রয়েছে। এসব সেতুর কারণে ভৈরব নদের নৌযোগাযোগ স্থাপন এবং জোয়ার–ভাটার প্রবাহ নির্বিঘ্ন করা সম্ভব হচ্ছে না।

নদের দুই পাশে এক্সকাভেটর ও মাঝখানে ড্রেজার ব্যবহার করে খনন করলে নদের তলদেশ সুষমভাবে খনন হতো। তা না করে কেবল এক্সকাভেটর ব্যবহার করে নদে এবড়োখেবড়ো করে খনন করা হয়েছে। ফলে খনন করা নদের তলদেশজুড়ে মাটি উঁচু উঁচু হয়ে আছে।

পাউবো, নদটির পারের বাসিন্দা, নদী ও পরিবেশ আন্দোলনকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভৈরবের ওপর থাকা প্রায় সব সেতুর দৈর্ঘ্য ১৬ দশমিক ৪ থেকে ১২০ ফুটের মধ্যে। কেবল একটি সেতুর দৈর্ঘ্য ১৭৭ দশমিক ১১২ ফুট। অথচ নদের প্রশস্ততা ১৫০ থেকে ২৫০ ফুট। দুই পাড় মাটি দিয়ে ভরাট করে নদের প্রশস্ততা কমিয়ে এনে এসব সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এটিও পানিপ্রবাহ না ফেরার একটি কারণ।

অন্যদিকে নদের ওপরে থাকা সেতুগুলোর কংক্রিটের তলদেশ উঁচু করে নির্মিত হয়েছে। এখন নদ খনন করা হলেও পানিপ্রবাহ সেতুর উঁচু তলদেশে আটকে যাচ্ছে। এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, খননকাজ যথাযথভাবে করা হয়নি। নদের দুই পাশে এক্সকাভেটর ও মাঝখানে ড্রেজার ব্যবহার করে খনন করলে নদের তলদেশ সুষমভাবে খনন হতো। তা না করে কেবল এক্সকাভেটর ব্যবহার করে নদে এবড়োখেবড়ো করে খনন করা হয়েছে। ফলে খনন করা নদের তলদেশজুড়ে মাটি উঁচু উঁচু হয়ে আছে। এতে পানিপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।

এর বাইরে নদের ওপরের সেতুগুলো নিচু করে নির্মাণ করার কারণে এগুলোর নিচ দিয়ে এমনিতেই বড় নৌযান চলাচল করানো সম্ভব নয়। এসব সেতু বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) মানদণ্ড মেনে উঁচু করে পুনর্নির্মাণ করা ছাড়া খননের উদ্দেশ্য সফল হবে না।

তবে পাউবো যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী দাবি করেন, ‘সঠিকভাবে ভৈরব নদ খনন করা হয়েছে। কিন্তু নদের ওপর নির্মিত অপ্রশস্ত ৫২টি সেতুর কারণে নদে জোয়ার আসছে না। সেতুগুলো অপসারণ করে নদের প্রশস্ততা অনুযায়ী পুনর্নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো দপ্তরগুলোর কোনো উদ্যোগ পাইনি।’

সেতু নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষ এলজিইডি যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, ভৈরব নদের ওপর সেতু সম্প্রসারণের কাজ আগেই শুরু করা হয়েছে। তাঁদের চারটি সেতু সম্প্রসারণের কাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে সব সেতু সম্প্রসারণ করা হবে। সেতু নির্মাণকারী অন্য কর্তৃপক্ষ ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তর, বিএডিসি, সওজ বলছে, বিষয়টি সম্পর্কে তাঁরা অবহিত। কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। 

সঠিকভাবে ভৈরব নদ খনন করা হয়েছে। কিন্তু নদের ওপর নির্মিত অপ্রশস্ত ৫২টি সেতুর কারণে নদে জোয়ার আসছে না। সেতুগুলো অপসারণ করে নদের প্রশস্ততা অনুযায়ী পুনর্নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো দপ্তরগুলোর কোনো উদ্যোগ পাইনি।
পাউবো যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী

ভৈরবের প্রবাহপথ

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার মুরটি গ্রামে পদ্মার শাখা জলঙ্গিতে ভৈরবের জন্ম। এরপর এঁকেবেঁকে ভৈরব মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা, ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর, যশোর জেলার তাহেরপুর, আফ্রা ও অভয়নগর এবং খুলনা জেলার ফুলতলা, দিঘলিয়া ও দৌলতপুর হয়ে খুলনা নগরের কাস্টমঘাট এলাকায় ভৈরব রূপসা নদীতে গিয়ে মিশেছে। চৌগাছার তাহেরপুর কপোতাক্ষের উৎসমুখ থেকে খুলনার রূপসা-ভৈরবের মিলনস্থল পর্যন্ত ভৈরবের মোট দৈর্ঘ্য ১৩৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে রূপসা-ভৈরবের সংগমস্থল থেকে যশোরের বসুন্দিয়া পর্যন্ত ভৈরবের ৪১ কিলোমিটার প্রবহমান। আর বসুন্দিয়া থেকে সদর উপজেলার রূপদিয়া পর্যন্ত ২১ কিলোমিটার ক্ষীণধারা প্রবহমান। সেখান থেকে চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুরের কপোতাক্ষের উৎসমুখ পর্যন্ত ৭১ কিলোমিটারে পানির প্রবাহ নেই।

এটা যে ভৈরব নদ, সেটা প্রথমে দেখলে বিভ্রান্ত হতে হয়। যশোর শহরের দড়াটানা এলাকায়

খনন প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল ভৈরব নদের নাব্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রকল্প এলাকার নৌযোগাযোগের উন্নয়ন, মাথাভাঙ্গা নদের সঙ্গে ভৈরব নদের সংযোগ স্থাপন, ভৈরব নদ ও পার্শ্ববর্তী খালগুলো খননের মাধ্যমে নিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নয়ন, যশোর জেলার চৌগাছা, সদর, বাঘারপাড়া ও অভয়নগর উপজেলার ২২ হাজার হেক্টর এলাকার নিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সেচব্যবস্থার সম্প্রসারণসহ ভৈরব নদ ও পার্শ্ববর্তী খালগুলো খননের মাধ্যমে মৎস্য চাষের উন্নয়ন। পানিপ্রবাহ না ফেরায় এসবের কিছুই হয়নি।

ভৈরব নদের মাঝখানে কাটেনি। সরকারকে দেখাইছে নদ ঠিকমতো কাটা হয়েছে। আসলে তা হয়নি।
আবদুল করিম

ভৈরব যত পশ্চিমে যায়, প্রশস্ততা কমে

ভৈরবের অববাহিকা এলাকা ধরে সরেজমিনে দেখা যায়, আফ্রা ঘাট এলাকায় ভৈরবের চেহারা স্পষ্ট। যত পশ্চিমে এগোনো যায়, ভৈরবের প্রশস্ততা তত কমেছে। কমেছে স্রোত। চার কিলোমিটার এগিয়ে নদের ওপর সংকীর্ণ সেতু। নদে ভরে আছে কচুরিপানায়। যশোর সদর উপজেলার মাথাভাঙ্গা এলাকায় সংকীর্ণ সেতুর সামনে বাঁশের লাঠি পুঁতে কচুরিপানা আটকে মাছ চাষ করা হচ্ছে। বাঘারপাড়া উপজেলার ছাতিয়ানতলা পর্যন্ত নদের স্রোত কিছুটা বেশি। ছাতিয়ানতলায় নদের ওপর নির্মিত পুরোনো সেতু ভেঙে নতুন একটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। সেতু নির্মাণ করতে নদের মাঝখানে কিছুটা জায়গা ফাঁকা রেখে দুই পাশ মাটি দিয়ে বাঁধ দেওয়া হয়েছে।

ভৈরব নদের ‌'সরু' সেতু ভেঙে কম উচ্চতার সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এ জন্য নদের মাঝে অল্প জায়গা রেখে দুই পাশ মাটি দিয়ে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। যশোর সদর উপজেলার রাজারহাট এলাকায়

সদর উপজেলার ঘোপ গ্রামের আবদুল করিম (৬৫) বলেন, ‘ভৈরব নদের মাঝখানে কাটেনি। সরকারকে দেখাইছে নদ ঠিকমতো কাটা হয়েছে। আসলে তা হয়নি।’

যশোর শহর দিয়ে ভৈরব গেছে। শহরের যে বড় নর্দমা চোখে পড়ে, দুর্গন্ধ নাকে আসে, সেটি আসলে ভৈরব। শহরের অংশের ভৈরব এখন ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। শহরের যাবতীয় মেডিকেল বর্জ্য ও ভবনের শৌচাগারের মানববর্জ্য সরাসরি পাইপলাইনের মাধ্যমে ভৈরব নদে ফেলা হচ্ছে। এতে নদের পানি কালো কুচকুচে হয়ে পড়েছে। পানি দুর্গন্ধযুক্ত। শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানায় সেতুর ওপর দাঁড়ালে দেখা যায়, ভৈরবের পাড়ের ২০০ মিটার এলাকায় সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হয়েছে।

শহর ছেড়ে ভৈরব এগিয়েছে। সামনে খয়েরতলা বাজার। সেখানে নদের ওপর সরু সেতু। সেতুর দুই পাশের কিছু অংশের মাটি কাটা হয়নি। নদ ভরে আছে কচুরিপানায়। সেতুর এক পাশে নদের পাড়ে ধান চাষ করা হচ্ছে।

আশাবাদ হতাশায় পরিণত

ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির বলেন, ‘ভৈরবের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য পাউবোর অদূরদর্শিতা ও স্বচ্ছতার অভাব দায়ী। আমাদের দাবি ছিল, নৌ চলাচল করার উপযোগী করে ভৈরব নদ খনন করতে হবে। এ ছাড়া নদের ওপরে থাকা অপরিকল্পিত ৫২টি সেতু নৌ চলাচলের উপযোগী করে সংস্কার করতে হবে। চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় মাথাভাঙ্গার সঙ্গে ভৈরব নদের সংযোগ দিতে হবে। কিন্তু তা না করে নদীতট আইন উপেক্ষা করে যেনতেনভাবে নদের খননের কাজ শেষ করা হয়েছে। বর্তমানে চারটি সেতু সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। সেগুলোও নিয়ম মেনে করা হচ্ছে না। ফলে প্রকল্পের সুফল অর্জিত হচ্ছে না। ভৈরব নদ সংস্কারে মানুষের মধ্যে যে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল, তা হতাশায় রূপান্তরিত হয়েছে। মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতে নদের মধ্যে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হয়েছে। আমাদের আন্দোলন অব্যাহত আছে। আমরা দ্রুত এ ব্যাপারে নতুন কর্মসূচি দেব।’