কক্সবাজার শহরের হলিডের মোড় এলাকায় হোটেল সানমুনের একটি কক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ নেতা সাইফ উদ্দিনের (৪৫) লাশ উদ্ধারের ঘটনায় রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। তবে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে মাস্ক ও পাঞ্জাবি পরিহিত এক তরুণকে খুঁজছে পুলিশ। হোটেলের সিসিটিভি ফুটেছে পাঞ্জাবি পরা ওই তরুণকে সাইফ উদ্দিনের কক্ষ থেকে বেরিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে যেতে দেখা গেছে। এ ছাড়া সন্দেহভাজন চারজনকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, সাইফ উদ্দিনকে পরিকল্পিতভাবে হোটেলকক্ষে পৈশাচিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নিহত সাইফের শরীরে একাধিক ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। বিছানা ছিল এলোমেলো। কক্ষের মেঝেতে রক্ত ছড়িয়ে আছে। রহস্যজনক হলেও সোমবার বিকেল চারটা পর্যন্ত হত্যার মূল রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। তবে তদন্ত চলছে।
হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজে মুখে মাস্ক ও পাঞ্জাবি পরা এক তরুণকে সাইফ উদ্দিনের কক্ষ থেকে বেরিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যেতে দেখা গেছে। ওই তরুণ হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। ওই তরুণকে ধরার চেষ্টা চলছে।
রোববার গভীর রাতে হোটেলের দ্বিতীয় তলার ২০৮ নম্বর কক্ষে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ এবং অন্যান্য আলামত সংগ্রহ করে অপরাধীদের শনাক্ত করার কাজ চালাচ্ছে পুলিশ। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় সোমবার বিকেল চারটা পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি।
নিহত সাইফ উদ্দিনের বাড়ি শহরের ঘোনাপাড়ায়। তাঁর বাবা সাবেক আনসার কমান্ডার আবুল বাশার। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাইফ উদ্দিন শহর আওয়ামী লীগের দুর্যোগ ও ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। সাইফ উদ্দিন সব সময় কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু) আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমলের সঙ্গেই থাকতেন। ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে করা একটি রাজনৈতিক মামলার আসামি হিসেবে হাজিরা দিতে গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজার আদালতে গিয়েছিলেন সাইফ।
হোটেলকক্ষে সাইফ উদ্দিনের হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে ছুটে যান কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুবুর রহমান, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বল করসহ দলীয় নেতা-কর্মীরা। হোটেলের সামনের প্রধান সড়কে দর্শনার্থীদের ভিড় লেগে যায়, তাতে যানবাহন চলাচলে ব্যাহত হয়।
সাইফ উদ্দিনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করে পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন, সাইফ উদ্দিন অত্যন্ত ভদ্র ও পরিচিত মুখ ছিলেন। হোটেলকক্ষে এমন হত্যাকাণ্ড কেউ মেনে নিতে পারছেন না। শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ ব্যর্থ। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাইফ উদ্দিন হত্যার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করতে না পারলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
নিহত সাইফ উদ্দিনের বন্ধু কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা। তিনি বলেন, হোটেলকক্ষের একটি খাটে সাইফ উদ্দিনের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ সময় তাঁর দুই হাত রশি দিয়ে বাঁধা ছিল। পরনে ছিল খয়েরি রঙের প্যান্ট। গায়ে কোনো কাপড় ছিল না। ডান পায়ের হাঁটুতে রক্তের দাগ লেগে ছিল। লাশের অবস্থা দেখে পরিষ্কার ধারণা হয়, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
ঘোনাপাড়ার বাসিন্দা ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বল কর বলেন, ছাত্রলীগ থেকে শহর আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন সাইফ। তাঁর কোনো শত্রু ছিল না। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি বাবার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু হোটেলকক্ষে তাঁর এমন মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছে না।
সোমবার দুপুরে কক্সবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, নিহত সাইফ উদ্দিন তাঁর সঙ্গে থাকতেন। গত শনিবার রাত দুইটার দিকে তিনি সাইফকে তাঁর বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। পরের দিন তিনি ঢাকায় গেছেন। সোমবার সকালে সাইফ উদ্দিনের মৃত্যুর খবর শুনে তিনি ঢাকা থেকে কক্সবাজারে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
হোটেল সানমুনের একজন কর্মচারী বলেন, রোববার রাতে সাইফ উদ্দিন দুজনকে সঙ্গে নিয়ে হোটেলের দ্বিতীয় তলার ২০৮ নম্বর কক্ষে ওঠেন। সোমবার সকালে সাড়াশব্দ না পেয়ে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ এসে খাটের ওপর হাত বাঁধা অবস্থায় সাইফ উদ্দিনের লাশ উদ্ধার করে। হোটেল রেজিস্টারে ২০৮ নম্বর কক্ষটি সাইফ উদ্দিনের নামে ছিল।
পুলিশের ভাষ্য, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কমপক্ষে তিনজন জড়িত থাকতে পারেন। যাঁরা নিহত সাইফ উদ্দিনের পূর্বপরিচিত হতে পারেন। তা ছাড়া প্রায় সময় সাইফ উদ্দিন বন্ধুদের নিয়ে এই হোটেলে আড্ডা দিতেন। রোববার রাতে আড্ডার সময় নানা কৌশলে চেতনানাশক কিছু খাইয়ে সাইফ উদ্দিনকে অচেতন করা হতে পারে। এরপর শ্বাসরোধে হত্যার পর শরীরে একাধিক ছুরিকাঘাত করা হতে পারে। অথবা কক্ষে ধস্তাধস্তির পর ছুরিকাঘাতে সাইফকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যেতে পারে। নারীঘটিত কিংবা ব্যবসায়িক কোনো লেনদেনের বিরোধে এই হত্যাকাণ্ড হতে পারে।