মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা এখানে ক্যাম্প করে মানুষ হত্যা করত। সে সময় থেকেই ভয়ে মানুষ এ এলাকা দিয়ে চলাচল করে না।
ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে কংস নদের পারে সুনসান গ্রাম বড়ইকান্দি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের একটি বধ্যভূমি রয়েছে গ্রামটিতে। দীর্ঘদিন অযত্নে আর অবহেলায় পড়ে ছিল বধ্যভূমিটি। গ্রামবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সাল থেকে উপজেলা প্রশাসন এ বধ্যভূমিকে তালিকাভুক্ত করে। তবে বধ্যভূমিটিতে কোনো স্মৃতিফলক নেই। এমনকি বধ্যভূমির স্থানে নেই কোনো সাইনবোর্ড।
গ্রামবাসীর দাবি, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত এ বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হোক।
গতকাল মঙ্গলবার বড়ইকান্দি বধ্যভূমিতে গিয়ে দেখা যায়, বধ্যভূমির পাশে কংস নদ খননের বালু স্তূপ করে রাখা। বধ্যভূমির স্থানটি ঘিরে কোনো সীমানাপ্রাচীর নেই। নেই কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা স্থাপনা।
গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর কোনো স্থাপনা না থাকায় মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের একটি দেয়ালের পরিত্যক্ত অংশকে ঘিরে গ্রামের মানুষ ডিসেম্বর মাসে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। ২০২০ সালের বিজয় দিবসে ফুলপুর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রথম একটি ফুলের তোড়া পাঠানো হয় বধ্যভূমিতে।
গ্রামবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা প্রশাসন বড়ইকান্দি বধ্যভূমিকে তালিকাভুক্ত করেছে। তবে সেখানে স্থাপনা নির্মাণের ব্যাপারে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা আসেনি।শীতেষ চন্দ্র সরকার, ইউএনও, ফুলপুর
বড়ইকান্দি গ্রামের প্রবীণ শফিকুল ইসলাম (৭৫) বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বড়ইকান্দি গ্রামে কংস নদের পারে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল। রাজাকাররা ওই ক্যাম্পে মুক্তিকামী মানুষদের ধরে আনত। পরে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিকামী মানুষদের গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে নির্যাতন করত। নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যা করত। ওই সব লাশ কখনো কংস নদে ভাসিয়ে দিত, আবার কখনো ক্যাম্পের পাশে কংস নদের পারে মাটিচাপা দিত। কত মানুষকে যে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করেছে, তার কোনো হিসাব নেই। রাতভর মানুষদের নির্যাতন করে মেরে ফেলা হতো। সকালে ক্যাম্পের পাশের ফসলের খেতে গুলির খোসা পড়ে থাকত। অনেক লাশ কংস নদের স্রোতে ভেসে আসত বড়ইকান্দিতে। গ্রামের মানুষ ওই সব লাশ আবার ভাসিয়ে দিয়েছেন, নয়তো নদের পারেই মাটিচাপা দিয়েছেন।
গ্রামের আরেক প্রবীণ ব্যক্তি জয়নাল আবেদিন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগপর্যন্ত ময়মনসিংহ থেকে হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলার বাস বড়ইকান্দি এলাকা দিয়ে যেত। কংস নদের পারে বড়ইকান্দি ছিল জমজমাট এলাকা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা এখানে ক্যাম্প করে মানুষ হত্যা করত। সে সময় থেকেই ভয়ে মানুষ এ এলাকা দিয়ে চলাচল করে না।
গ্রামের লোকজন জানান, বড়ইকান্দি বধ্যভূমির কথা মানুষ জানলেও কখনো স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসে কেউ এখানে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা করত না। ২০১৬ সালে স্থানীয় বাসিন্দা ও সাংবাদিক আবদুল মোতালেবের উদ্যোগে একটি ফেসবুক গ্রুপে প্রথম বড়ইকান্দি বধ্যভূমির কথা প্রচারিত হয়। এর পর থেকে প্রতিবছর বিজয় দিবসের দিন বড়ইকান্দি বধ্যভূমিতে গ্রামের মানুষ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসছেন। পাশাপাশি এ বধ্যভূমিকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া বা তালিকাভুক্ত করার দাবিতে বিভিন্ন সময় গ্রামের মানুষ মানববন্ধন করেছেন। পরে ২০২০ সালের বিজয় দিবস থেকে ফুলপুর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ বধ্যভূমিতে ফুল দেওয়া হচ্ছে। তবে বধ্যভূমিতে কোনো ধরনের স্থাপনা বা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়নি। এমনকি বধ্যভূমিতে কোনো ধরনের সাইনবোর্ড বা নামফলক নেই।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফুলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শীতেষ চন্দ্র সরকার প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা প্রশাসন বড়ইকান্দি বধ্যভূমিকে তালিকাভুক্ত করেছে। তবে সেখানে স্থাপনা নির্মাণের ব্যাপারে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা আসেনি।