পুলিশের চাকরিতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখে তাসমিনা। পুলিশ একাডেমিতে অনেক বড় বড় ঘোড়া আছে। পুলিশের চাকরি পেলে ঘোড়া ছোটানোর স্বপ্নটা পূরণ হবে। সে জন্য বয়স পূর্ণ হলেই পুলিশে যোগ দিতে চায় সে।
২০১৫ সালের জুন মাস প্রথম তাসমিনাদের বাড়িতে যাই। নওগাঁর নিভৃত গ্রাম চকসুবল। এজমালি একটি মাটির ঘর। তারই ছোট্ট একটি কক্ষ ওদের ভাগে। ভেতরে আলো-বাতাস কমই যায়। তাসমিনা তখন ফ্রক পরা ছোট মেয়ে। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ঠিক আট বছর পর গত মাসে আবার গেলাম। কিছুই বদলায়নি। শুধু অমসৃণ মাটির দেয়ালে লেগেছে ঘোড়দৌড়ের ব্যানার। আর ছোট্ট তাসমিনা মাথায় বড় হয়েছে। কলেজে পড়ে।
আগে তাসমিনার নিজের ঘোড়া ছিল না। অন্যের ঘোড়া জিতিয়ে দিয়ে পুরস্কারটা মালিকের হাতে তুলে দিয়ে শুধু জয়ের আনন্দটা নিয়ে বাড়ি ফিরত। এখন তার নিজের ঘোড়া হয়েছে। তাসমিনাও আর ছোট্টটি নেই। শুধু নিজের এলাকায় খেলে না। এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যায়। কিন্তু দূরদূরান্তে ঘোড়া পরিবহনের যে খরচ, তা পুরস্কারে পোষায় না। তাই দূরের খেলায় স্থানীয় মালিকের ঘোড়াই তাকে নিতে হয়। জিতিয়ে দিয়ে আগের মতোই পুরস্কারটা মালিকের হাতে তুলে দিয়ে জয়ের আনন্দটুকু নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। মেয়ের এই অদম্য জয়ের নেশাকে দমাতে না পেরে বাবা ওবায়দুল হক মেয়েকে নিয়ে ছোটেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। এ মৌসুমে ২১টির বেশি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ১৮টিতেই জয়ী হয়েছে এই বালিকা ঘোড়সওয়ার।
তার ফেসবুক পেজে দেখা যায়, চান্দাইকোনার খেলার পরে মাইকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সময় সে দর্শকদের উদ্দেশে বলছে, আমার ঘোড়া দেখেন যেটার মুখের এক পাশে তাসমিনা আর অপর পাশে “প্রথম আলো” লেখা আছে।’
তাসমিনা খাতুনের বাড়ি যেতে নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার বিহারীনগর এলাকায় বাস থেকে নামতে হয়। সেখান থেকে চকসুবল গ্রাম প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। যেতে হয় ছাদখোলা অটোরিকশায়। গত ১২ মে বিহারীনগর থেকে ওসমান আলীর অটোরিকশায় চাপলাম। সঙ্গে ছিলেন প্রথম আলোর রাজশাহী বন্ধুসভার উপদেষ্টা ফারুক হোসেন। ঘোড়সওয়ার তাসমিনার নাম শুনে বেশ খাতির করলেন ওসমান আলী। বড় রাস্তা থেকে মাটির রাস্তায় নেমে ঠিক তাসমিনাদের বাড়ির সামনে বাঁশতলায় নামিয়ে দিলেন।
তাসমিনারা তিন বোন ও এক ভাই। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। ভাই নূরনবী নবম শ্রেণিতে পড়ে। আর ছোট বোন হালিমা এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। সে-ও বোনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইতিমধ্যে বিভিন্ন জেলার প্রতিযোগিতায় যাচ্ছে। একজন ক্ষুদ্র মৎস্যচাষি বাবা নিজের ব্যবসা ফেলে মেয়েদের নিয়ে ছুটে বেড়ান এক জেলা থেকে আরেক জেলায়।
আমি শুনেছি পুলিশ একাডেমিতে অনেক বড় বড় ঘোড়া আছে। পুলিশের চাকরি পেলে আমার সেই ঘোড়া ছোটানোর স্বপ্নটা পূরণ হবে।তাসমিনা
প্রথম আলো তাসমিনাকে প্রথম জনসমক্ষে নিয়ে আসে। প্রথম আলোর উদ্যোগে তাকে নিয়ে ‘ঘোড়সওয়ার’ নামের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন তানহা জাফরিন। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাকে ঘোড়া কেনার টাকা দেয়া হয়। এই সহযোগিতার কথা মনে রেখেছে তাসমিনা। প্রতিযোগিতায় নামার সময় ঘোড়ার মুখের এক পাশে নিজের নাম, অপর পাশে ‘প্রথম আলো’ লিখে নেয়। বাবা ওবায়দুল হক বললেন, ‘ঘোড়াটি যতবার পাক দিবে, দর্শকেরা ততবার প্রথম আলো লেখাটি দেখতে পাবে।’
সাধারণত শীতের মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জেলায় এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তখন তাসমিনার ডাক পড়ে। এবার সে শুধু বগুড়া জেলার ১০টি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। এ ছাড়া নওগাঁ, রাজশাহী, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, চান্দাইকোনা (সিরাজগঞ্জ), ঠাকুরগাঁও, রংপুর, পার্বতীপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। তার ফেসবুক পেজে দেখা যায়, চান্দাইকোনার খেলার পরে মাইকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সময় সে দর্শকদের উদ্দেশে বলছে, ‘আমার ঘোড়া দেখেন যেটার মুখের এক পাশে তাসমিনা আর অপর পাশে “প্রথম আলো” লেখা আছে।’
২০১৫ সালের ১৭ জুন প্রথম আলোর অধুনা পাতায় ‘এক দুঃখিনী ঘোড়সওয়ারের গল্প’ শিরোনামে তাসমিনার এই ঘোড়দৌড়ে জেতার গল্পটি ছাপা হয়। ওই বছর ঢাকার একজন দয়ালু ব্যবসায়ী তাসমিনাকে একটি ঘোড়া কিনে দেন। কিন্তু ঘোড়াটি এক চোখে দেখতে পেত না। সেই ঘোড়াটি তার কোনো কাজে আসেনি। পরে অল্প কিছু দামে ওবায়দুল হক ঘোড়াটি বিক্রি করে দেন।
মেয়েটির নিজের ঘোড়ার দুঃখ দূর করার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে একবার দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়। সেই টাকা দিয়ে ওবায়দুল হক মেয়েকে সুন্দর একটি ঘোড়া কিনে দেন। প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে কোমর ভেঙে ঘোড়াটি প্রায় অচল হয়ে যায়। মাত্র ৪৯ হাজার টাকায় ওবায়দুল হক ঘোড়াটি বিক্রি করে দেন। মেয়েটির আবার মন খারাপ হয়। দ্বিতীয়বার তার ঘোড়া কেনার জন্য প্রথম আলো থেকে আরও ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। তাসমিনা বলেছিল, ‘প্রথম আলোর টাকায় কেনা আগের ঘোড়াটিও ভালো ছিল। এবারের ঘোড়াটি তার চেয়েও ভালো।’ কিন্তু ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া সব সময় নিখুঁত রাখতে হয়। একটি ঘোড়া নিয়ে বেশি দিন দৌড়ানো যায় না। সেই ঘোড়াটিও বিক্রি করে তাসমিনা সম্প্রতি আরেকটি ঘোড়া কিনেছে। টেলিভিশন চ্যানেল মাছরাঙা তাকে সহায়তা করেছে।
গত ১২ মে তার বাড়িতে গিয়ে সেই মাটির ঘরেই বসতে হলো। তাদের কোনো পরিবর্তন হয়নি, শুধু মাটির ঘরে জড়ো হয়েছে কিছু মেডেল আর অনুষ্ঠানের ব্যানার। তাসমিনা জানাল, ময়মনসিংহের খেলায় সে একটা রেফ্রিজারেটর ও একটি এলইডি টেলিভিশন পেয়েছিল। দুটোই ঘোড়ার মালিককে দিয়ে আসতে হয়েছে। ট্রাক ভাড়া করে অত দূর নিজের ঘোড়া নিয়ে গেলে যে খরচ হয়, পুরস্কারে তা পোষায় না। ঘোড়ার মালিক যাতায়াত ও থাকা-খাওয়া বাবদ খরচ দিয়েছিল। সে টাকা পথেই শেষ হয়ে গেছে। দূরের প্রতিযোগিতায় শুধু ঘোড়দৌড়ে জেতার আনন্দটুকুই পাওয়া যায়। তবু সে খেলা ছাড়তে চায় না। যত দূরেই হোক যেতে চায়।
পুলিশের চাকরিতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখে তাসমিনা। এত পেশা রেখে কেন পুলিশে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা—জানতে চাইলে তাসমিনা বলে, ‘আমি শুনেছি পুলিশ একাডেমিতে অনেক বড় বড় ঘোড়া আছে। পুলিশের চাকরি পেলে আমার সেই ঘোড়া ছোটানোর স্বপ্নটা পূরণ হবে।’ সে ১৭ পেরিয়েছে । তার ইচ্ছা বয়স পূর্ণ হলেই পুলিশের চাকরির পরীক্ষায় অংশ নেবে। তবে এই মুহূর্তে বাবার ব্যবসা নেই। ঠিকমতো পড়াশোনার খরচ চালাতে পারছেন না। এ নিয়ে তাসমিনার মন খারাপ।
বিদায় দেওয়ার সময় ঘোড়া নিয়ে বের হলো তাসমিনা। গ্রামের মাঠে ধান কাটা হয়েছে। সেখানেই ঘোড়া ছোটাল। ছিপছিপে গড়নের ঘোড়াটি তিরবেগে ছুটছে। যেন-বা পাল্লা দিয়ে তাসমিনার স্বপ্নও ছুটছে। তাসমিনারা ছুটে চলে, ওরা হেরে যাওয়ার মেয়ে নয়।