মির্জা আজমের স্ত্রী আলেয়া আজমের নামে জামালপুর শহরের চারটি মৌজায় ১০ একর ২৬ শতাংশ জমি থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
পুরো জামালপুরে তাঁর কথার বাইরে যাওয়ার সাহস ছিল না অন্য কোনো সংসদ সদস্য (এমপি), দলীয় নেতা-কর্মী, প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ কারও। সরকারি দপ্তরের ঠিকাদারি, জমি দখল, দলীয় মনোনয়ন, দলীয় পদপদবি পাওয়া না–পাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।
তিনি মির্জা আজম। তিনি জামালপুর-৩ (মেলান্দহ-মাদারগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। ১৬ বছরের ব্যবধানে তিনি বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। ১৬ বছর ধরে ‘চুপ’ থাকা মানুষগুলো এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন, বের হতে শুরু করেছে তাঁর রাজত্বের নানা অন্যায় ও অনিয়মের তথ্য।
মির্জা আজম তাঁর স্ত্রী, সন্তান, পাঁচ ভাইসহ পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের নামে-বেনামে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ গড়ে তুলেছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ।
আশির দশকে মির্জা আজমকে সবাই খাদ্য বিভাগের পরিবহন ঠিকাদার হিসেবেই চিনতেন। খাদ্য বিভাগের ধান, চাল, গমসহ বিভিন্ন পণ্য সরবরাহের ট্রাকসহ পরিবহনের ঠিকাদার ছিলেন। জামালপুর-৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে ১৯৯১ সালে প্রথম এমপি নির্বাচিত হন। আর পেছনে তাকাতে হয়নি। টানা সাতবার এমপি নির্বাচিত হন। তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। এ ছাড়া তিনি সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে পলাতক মির্জা আজম ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। তিনি দেশ ছেড়েছেন বলে স্থানীয়ভাবে শোনা যায়। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায়নি।
হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে মির্জা আজমের স্ত্রী আলেয়া আজমের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩৭ লাখ ২৬ হাজার ৬৮ টাকা। এর মধ্যে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া নেত্রকোনা শহরে ১০ লাখ টাকা মূল্যের ৬ শতাংশ জমি, ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা মূল্যের ২ দশমিক ১৯ একর কৃষিজমি ছিল। তখন তাঁর নামে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পোস্টাল সঞ্চয় ও ব্যবসায়িক মূলধনের তথ্য হলফনামায় ছিল না। ২০২৪ সালের হলফনামার তথ্যানুযায়ী, তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৯ কোটি ৫১ লাখ ১ হাজার ৪০১ টাকা। এর মধ্যে ২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট, ৩ কোটি ৪১ টাকা মূল্যের ২টি দালান ও ১ কোটি ১৬ লাখ ৪৭ হাজার ১৬৮ টাকার ব্যবসায়িক মূলধন।
জামালপুর সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্য বলছে, আলেয়ার নামে জামালপুর শহরের চারটি মৌজায় ১০ একর ২৬ শতাংশ জমির রয়েছে। এ ছাড়া বড় মেয়ে মির্জা আফিয়া আজমের নামে দেউরপাড় চন্দ্রা ও পলাশগড় মৌজায় ৪২ শতাংশ জমি আছে। এসব দলিলে মির্জা আজমের স্ত্রীর দুই রকম নাম রয়েছে, দেওয়ান আলেয়া ও মিসেস আলেয়া আজম। জামালপুর শহরে পৌরসভা ভবনের পাশে আছে মির্জা আজমের স্ত্রী আলেয়া আজমের নামে বিলাসবহুল বাড়ি আলেয়া কটেজ। ৫ আগস্টের পর বাড়ি ভাঙচুর, লুটপাটের পর পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অন্তত সাতজন নেতা বলেন, জামালপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন ওরফে ছানু ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক নারায়ণ পাল রানার মাধ্যমে আলেয়া আজম স্থানীয় রাজনীতিতে দলীয় পদপদবি পাওয়া, জমি দখল, থানার ওসিসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের বদলি, বিভিন্ন দপ্তরের ঠিকাদারি কাজের কমিশন–বাণিজ্য করতেন। আলেয়াকে ম্যানেজ করা মানেই ছিল মির্জা আজমকে ম্যানেজ করা। শুধু জামালপুর নয়, নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও তাঁর ব্যাপক প্রভাব ছিল।
ছানোয়ার হোসেন ও নারায়ণ পাল পলাতক ও তাঁদের মুঠোফোনও বন্ধ থাকায় এসব বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
শহরের দেউরপাড় চন্দ্রা এলাকায় মির্জা আজম তাঁর স্ত্রীর নামে আট একর জমির ওপর ‘আলেয়া’ গার্ডেন নামের একটি পার্ক রয়েছে। পার্কের জন্য দরিদ্র মানুষের জমি দখল ও যাঁরা জমি দিতে চাননি, তাঁদের পুলিশ দিয়ে ধরে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে দেখা যায়, পার্কের প্রধান ফটকে ইট দিয়ে দেয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে। পার্কের বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর অবস্থায় পড়ে রয়েছে। পার্কের বিষয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে এখনো অনেকে মির্জা আজমের ভয়ে কথা বলতে সাহস পাচ্ছিলেন না।
মনজুরুল হক জামালপুর পৌর শাখার ১২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের তিনবারের সাবেক সভাপতি। তাঁর ছোট ভাই ওই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি বলেন, ‘পার্কটির জন্য আমি ১৩ শতাংশ জমি বিক্রি করেছিলাম। পার্কটির সীমানাপ্রাচীর করার সময় জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সোহরাব হোসেন ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক নারায়ণ পালের নেতৃত্বে আরও ১৩ শতাংশ জমি দখল করা হয়। বারবার মির্জা আজমের কাছে যাওয়ার পরও কাজ হয়নি। পার্কটির পূর্ব পাশে তাঁর আরও দুই একর জমি রয়েছে। সেই জমি নিতে অনেক চাপ সৃষ্টি করেন তিনি। ওই জমিতে মাছের খামার ছিল, দেখাশোনা করত ছেলে। একদিন রাতের বেলায় ছেলেকে থানায় নিয়ে মারধর করা হয়। পরে অস্ত্র ও মাদক আছে—এমন অভিযোগে আরও দুবার ছেলেকে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে নেওয়া হয়।
দেউরপাড় চন্দ্রা এলাকার যুবক জসিম উদ্দিনের ৫২ শতাংশ জমি ছিল। তাঁর বাবা আবদুল জলিল ওই জমি চাষাবাদ করে সংসার চালাতেন। পার্কের পশ্চিম পাশে অবস্থিত জমিটি প্রথমে এওয়াজ বদলের প্রস্তাব দেওয়া হয়। পরে জলিলের ছেলে, মেয়ে ও জামাতাকে চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। পরে জলিল পুরো জমি পার্কের জন্য দেন। জসিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা গরিব। তাঁকে (মির্জা আজম) বিশ্বাস করে বাবা জমি দেন। এওয়াজ বদলে তিনি যে জমি দিয়েছিলেন, তার মধ্যে ১৬ শতাংশ জমির দাগ নম্বর ভুল। ফলে সেই জমি এখনো পাইনি। আমাদের তিনজনকে চাকরি দেওয়ার কথা ছিল। সেই চাকরিও দেওয়া হয়নি।’
এ ছাড়া মির্জা আজমের বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ বেগম ও তাঁর বোন রেখা বেগম, হান্নান মিয়া, মিজানুর রহমান, খোরশেদ আলম, আবদুর রশিদসহ অনেকের জমি দখল করার অভিযোগ রয়েছে।
পার্কের তত্ত্বাবধায়ক হাসান শেখ প্রথম আলোকে বলেন, সরকার পতনের পর মালিকপক্ষের কেউ আসেননি। মালিকপক্ষের নির্দেশে গেটে দেয়াল দেওয়া হচ্ছে। সবকিছু স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে দেখাশোনা করতে বলা হয়েছে।
পার্ক নির্মাণের সময় জমি দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে হাসান শেখ বলেন, ‘এখানে আমার চাচাতো ভাইদেরও জমি রয়েছে। তাঁদের অন্য জায়গায় জমি দেওয়া হয়েছে। আমার চাচাতো ভাইকে জমি দেওয়ার সুবাদে সরকারি চাকরি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সরকারি চাকরি দেননি, আউটসোর্সিংয়ের চাকরি দিয়েছেন।’
মির্জা আজমের বিরুদ্ধে সরকারি দুটি প্রতিষ্ঠানের টাকায়, জমি লিখে নিয়ে ও পৌরসভার ডাম্পিং স্টেশন বন্ধ করে প্রায় সাড়ে চার একর জমির ওপর জামালপুর রিক্রিয়েশন ক্লাব লিমিটেড নামের একটি বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে। ক্লাবটি শহরের পলাশগড়ে অবস্থিত। ক্লাবটির জন্য পলাশগড়ের একটি রাস্তাও বন্ধ করা হয়। ২০২৩ সালের ১২ মার্চ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ক্লাবটির উদ্বোধন করেন। সদস্য ৪৭০ জন। প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা করে ২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা নেয় ক্লাব কর্তৃপক্ষ। সদস্যদের মধ্যে বেশির ভাগ ঠিকাদার, আওয়ামী লীগের নেতা, জনপ্রতিনিধি, মির্জা আজমের অনুসারী ও বিভিন্ন পেশার অর্থবিত্তের মালিক।
ক্লাবটিতে শুধু রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে হাউজি খেলা ও মদ বিক্রি হতো। সরকারের পতনের পর বিক্ষুব্ধ লোকজন ক্লাবটিতে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এর পর থেকে কার্যক্রম প্রায় বন্ধ ছিল। ক্লাবের একটি ১০ তলা আধুনিক ভবন নির্মাণাধীন। ওই ভবনের কাজ শুরু ও ক্লাবটি আবারও চালু করতে অন্য সদস্যদের সমন্বয়ে একটি আহ্বায়ক কমিটিও করা হয়েছে।
জামালপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ছানোয়ার হোসেন পৌরসভার ৪ কোটি ২৬ লাখ টাকার দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে ক্লাবের সীমানাপ্রাচীর, রাস্তা ও নর্দমা নির্মাণ করে দেন। ওই জমিতে পৌরসভার ডাম্পিং স্টেশন দেখিয়ে প্রকল্প দুটি নেওয়া হয়। এ ছাড়া জেলা পরিষদ থেকে ৮৮ লাখ ৫১ হাজার টাকায় ক্লাবের বিশাল ফটক নির্মাণাধীন।
পলাশগড় এলাকার বাসিন্দা হারুন অর রশিদ বলেন, ‘ক্লাবটিতে মদ ও হাউজির নামে জুয়াসহ অসামাজিক কর্মকাণ্ড চলত। আমি প্রতিবাদ করায় ছানোয়ারের লোকজন আমাকে তুলে নিয়ে মারধর করেন।’
শহরের রামনগর গ্রামের বাসিন্দা মো. মুরাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই ক্লাবের মধ্যে আমার স্ত্রীসহ পাঁচজনের ১ একর ১০ শতাংশ জমি ছিল। ক্লাবটি যখন নির্মাণ করা চলছিল, হঠাৎ ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর মির্জা গোলাম কিবরিয়া তাঁর (মির্জা আজম) বাসায় আমাকে ডেকে নেন। পরে তিনি (মির্জা আজম) বলেন, জমিটি তো খাস। জমির সব কাগজপত্র থাকার কথা জানালে মির্জা আজম বলেন, ‘জীবনই যদি না থাকে, তাহলে জমি বা টাকা দিয়ে কী করবেন।’ আমাকে সেখানে রেখেই, গাড়িতে করে আমার স্ত্রীকে আনা হয়। বাধ্য হয়ে আমার স্ত্রী জমিটা রেজিস্ট্রি করে দেন। সরকার পতনের পর ওই রেজিস্ট্রি দলিল বাতিল চেয়ে আদালতে মামলা করেছি।’
ক্লাবটি নিয়ে নানা অভিযোগ উঠলে ১৪ সেপ্টেম্বর ক্লাব কর্তৃপক্ষ সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করে, সব নিয়ম মেনেই ক্লাবটি করা হয়েছে। কারও জমি দখল করা হয়নি। ১ একর ৩১ শতাংশ জমি কেনা হয়েছে। বাকি ৩ একর ১৬ শতাংশ পৌরসভা থেকে ইজারা নেওয়া হয়েছে।
জামালপুর জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, পশ্চাৎপদ একটি জেলায় শুধু বিনোদনের জন্য ক্লাবটি তৈরি করা হয়েছে। এর জন্য পৌরসভা ও জেলা পরিষদ থেকে অঢেল টাকা খরচ করা হয়েছে।
তবে জামালপুরের সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও পৌরসভার প্রশাসক শীতেষ চন্দ্র বলেন, জেলার আটটি পৌরসভার ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ডাম্পিং স্টেশনের সীমানাপ্রাচীর, রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণের কাজ করা হয়েছে। সেখানে ক্লাব করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
২০১৩ সালে জামালপুর শহরের নয়াপাড়া পাঁচ রাস্তা মোড় এলাকার একটি ভবনে বেসরকারি শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন মির্জা আজম। বোর্ড অব ট্রাস্টির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হয়। ২০১৯ সালে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড় নাওভাঙ্গাচর এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য সাড়ে ১৬ একর খাসজমি ইজারা নেওয়া হয়। এ ছাড়া নাওভাঙ্গাচরের শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি ভেঙে জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত আবুল কালাম বলেন, ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য চর ভরাট শুরু হয়। ভরাটের সময় পূর্ব পাশের নাওভাঙ্গাচরের দরিদ্র বাসিন্দাদের জমিতেও বালু ফেলা হয়। একপর্যায়ে ওই এলাকার শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি ভেঙে জমিগুলো দখলে নেওয়া হয়।
কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বলেন, মির্জা আজমের নির্দেশে সাবেক মেয়র ছানোয়ারের তত্ত্বাবধানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জমিগুলো দখল করেন। যাঁরা সহজে জমি ছাড়েননি, তাঁদের নির্যাতন করা হতো। জমির কোনো টাকাও দেওয়া হয়নি। পুলিশ দিয়েও হয়রানি করা হয়।
এ বিষয়ে সদ্য বদলি হওয়া জেলা প্রশাসক মো. শফিউর রহমান বলেন, তদন্তে যদি জমি দখলের বিষয়টি প্রমাণিত হলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নির্মাণে ব্রহ্মপুত্র নদ ভরাট বন্ধের দাবিতে দুটি সংগঠনের ব্যানারে গত ৯ সেপ্টেম্বর ফৌজদারি মোড়ে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে মানববন্ধন হয় ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জেলা শাখার ব্যানারে।
বাপা জেলা শাখার উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কিছু নেতার লোভের কারণে নদটির একটি অংশকে পরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। ওই ক্যাম্পাস নির্মাণে নদের বিশাল অংশ ভরাট করা হয়েছে। এরপরও প্রশাসন সাড়ে ১৬ একর জমি ক্যাম্পাসের নামে ইজারা দিয়েছে। প্রক্রিয়াটি বাতিলের দাবি করছি।’
ক্যাম্পাস নির্মাণ নিয়ে নানা অভিযোগ উঠলে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সংবাদ সম্মেলন করে। সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আবুল হাসনাত বলেন, কর্তৃপক্ষ সাড়ে ১৬ একর জমি ইজারা ও সাড়ে ৯ একর জমি কিনেছে। এসব জমির সব বৈধ কাগজপত্র রয়েছে।
হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় মির্জা আজমের বার্ষিক আয় ছিল ৪ লাখ ৪৮ হাজার ১৮৫ টাকা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩ কোটি ৬৬ লাখ ২ হাজার ৫৭ টাকায়। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ২০০৮ সালে নির্বাচনের সময় মির্জা আজমের কাছে নগদ ২৩ লাখ ৩২ হাজার ৬৮৫ টাকা ছিল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তাঁর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা, কোম্পানির শেয়ার ও স্টক এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ কোটি ৫৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৮ টাকা। সব মিলিয়ে ২০২৩ সালে তাঁর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৫ কোটি ৬৪ লাখ ৩০ হাজার ১০০ টাকা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় ৩১ কোটি ১০ লাখ ৮ হাজার ১৯২ টাকার স্থাবর সম্পদ দেখিয়েছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা অনুযায়ী, মির্জা আজমের নামে ৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা মূল্যের ১৭ দশমিক ৬৩ একর কৃষিজমি, ১২ কোটি ৮২ লাখ টাকা দামের প্রায় দেড় একর অকৃষিজমি, ১১ কোটি সাড়ে ২৮ লাখ টাকা মূল্যের ২টি দালান ও ৩৬ লাখ সাড়ে ১৯ হাজার টাকার ১টি ফ্ল্যাট আছে। এ ছাড়া জামালপুর শহরের বকুলতলায় দৃষ্টিনন্দন দোতলা একটি বাড়িও রয়েছে।
দলীয় নেতা–কর্মী ও মির্জা আজমের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের তথ্যানুযায়ী, ঢাকার ধানমন্ডিতে ৮ হাজার ২০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, বারিধারায় সাততলা বাড়ি, মিরপুরে ১২ তলা বাণিজ্যিক ভবন আছে মির্জা আজমের। ধানমন্ডিতে একটি ছয়তলা ভবন ছিল, দুটি বাদে বাকি ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি করা হয়েছে। ঢাকার আশুলিয়ায় রয়েছে একটি ভবন, সেটি পোশাক কারখানা হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। নেত্রকোনায় স্ত্রী আলেয়ার নামে ছয়তলা বাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া মির্জা আজমের দুটি বাণিজ্যিক জাহাজের মালিকানায় অংশীদারি ছিল, যা তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। কক্সবাজারে হোটেল ব্যবসায়েও তাঁর অংশীদারি ছিল। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ঠিকাদারি ব্যবসা রয়েছে তাঁর। মির্জা আজম, তাঁর তিন ভাই মাদারগঞ্জ পৌরসভার দুবারের সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য গোলাম কিবরিয়া, ঠিকাদার ও ব্যবসায়ী মির্জা গোলাম রব্বানি ও জামালপুর শহর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক মির্জা জিল্লুর রহমানের নামে তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের শেয়ার রয়েছে। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি প্রথম আলো।
জেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ, এলজিইডি ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নকাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন মির্জা আজম, তাঁর স্বজন ও অনুসারী। প্রতিটি দপ্তরের কাজ কে পাবে আর কে পাবে না, সেটাও তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করতেন।