বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের কক্ষে ঢুকে ছাত্রলীগের নেতাকে কুপিয়ে জখম ও মারধরের ঘটনার জেরে প্রতিপক্ষের দুটি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়েছে। কক্ষ দুটিতে থাকা দুই শিক্ষার্থীকে হলে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। আগের মারধরে জখম হওয়া ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দীন আহমেদের অনুসারীরা এসব কাজ করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাঁদের বেপরোয়া তৎপরতা, হুমকিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অন্য পক্ষগুলোর সমর্থকেরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকে ভয়ে ক্যাম্পাসে আসছেন না।
ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হামলার পর অন্য পক্ষগুলোর নেতাদের কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন, কেউ আত্মগোপনে আছেন। এই সুযোগে ক্যাম্পাসের একক নিয়ন্ত্রণ মহিউদ্দীনের কবজায় নিতে নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন তাঁর সমর্থকেরা। এ জন্য প্রতিপক্ষের সমর্থকদের ওপর চড়াও হচ্ছেন তাঁরা।
গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের ক্লাস সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থীদের ফরম বিতরণ শুরু হওয়ার কথা ছিল। এ সময় মহিউদ্দীনের সমর্থকেরা অন্য কাউকে ফরম কিনতে বাধা দেন এবং বিভাগের চেয়ারপারসন ইসরাত জাহানকে গালাগাল করেন। পরে ফরম বিতরণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মহিউদ্দীন সমর্থকদের চাওয়া, তাঁদের সমর্থক প্যানেলটি যেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই-বাংলা হলের ৩০১২ নম্বর কক্ষের শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম বলেন, বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মহিউদ্দীনের কর্মী-সমর্থকেরা তাঁর কক্ষে আসেন। এ সময় তিনি বাইরে ছিলেন। তাঁরা আশরাফুলের চেয়ার-টেবিল, বই-খাতা ছুড়ে ফেলেন। বিছানাপত্র বাইরে ফলে দেন। এ সময় কক্ষের অন্য সহপাঠীদের বলে যায়, আশরাফুল যেন এই হলে আর না আসে। তাঁর সিটে তাঁদের (মহিউদ্দীন) এক সমর্থককে তুলে দেওয়া হয়েছে।
আশরাফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ইমন-জিসান পক্ষের অনুসারী। এ জন্য তাঁর ওপর এই খড়্গ নেমেছে। আজ শুক্রবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখন এক বন্ধুর বাসায় থাকছি। নিরাপত্তার অভাবে হলে যেতে পারছি না। আর আমার সিটে ওদের কাউকে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছে।’
এর আগের দিন রাতে এই হলের পঞ্চম তলায় ৫০১০ নম্বর কক্ষে আমিনুল ইসলামের কম্পিউটার, বিছানা, বইপত্র ও অন্যান্য সবকিছু ভাঙচুর করে মহিউদ্দীনের সমর্থকেরা। আমিনুল ওই সময় হলে ছিলেন না। এরপর থেকে তিনি আর হলে যাচ্ছেন না। ফোন করা হলে আজ তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। আমিনুল ছাত্রলীগের রিয়াজ উদ্দীন মোল্লার সমর্থক। রিয়াজ মোল্লা বর্তমানে মহিউদ্দীনের মামলায় জেলে আছেন। একইভাবে এই হলের আরেক শিক্ষার্থীকে হল ছাড়ার জন্য হুমকি দিয়েছে মহিউদ্দীনের সমর্থকেরা। ওই শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ নেতা আলীম সালেহীর সমর্থক।
শের-ই-বাংলা হলের অন্তত ছয়জন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, গত মঙ্গলবারের ওই ঘটনার পর প্রতিদিন রাতে হলের প্রতিটি কক্ষে গিয়ে যাকে যাকে সন্দেহ হচ্ছে তাঁদের নানাভাবে ভয়ভীতি ও হুমকি দেওয়ায় হলজুড়ে এখন ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলেও এমন পরিস্থিতি চলছে।
জানতে চাইলে শের-ই-বাংলা হলের প্রাধ্যক্ষ আবু জাফর মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘মৌখিকভাবে অভিযোগ পাওয়ার পর গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে আমি হলের ওই দুটি কক্ষে গিয়েছি। সেখানে বৈধ শিক্ষার্থীদের নামিয়ে যাঁদের তুলে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের নেমে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হলের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা তৎপর আছি, সব সময় পর্যবেক্ষণ করছি। আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে হল প্রশাসন কঠোর অবস্থানে থাকবে।’
শুধু হলে নয়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সর্বত্রই মহিউদ্দীনের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এমন শুদ্ধি অভিযান চালানোর পরিকল্পনা নিয়ে তাঁর অনুসারীরা মাঠে নেমেছেন। এর ধারাবাহিকতায় প্রতিদিনই মহিউদ্দীনের ওপর হামলার ঘটনার প্রতিবাদে এবং আসামিদের গ্রেপ্তার দাবিতে মানববন্ধন, সমাবেশ, মশাল মিছিলসহ নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হচ্ছে। ক্যাম্পাসে নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতেই এমন কর্মসূচি আয়োজন করা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মহিউদ্দীন আহমেদ আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘হলে কিছু ঘটনা ঘটেছে, মিথ্যা বলব না। কয়েকজনকে হলে ঢুকতে নিষেধ করা হয়েছে। এটা এই হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহের ওপর নির্ভর করে করা হয়েছে। যেহেতু খুব ভোরে ঘটনা ঘটেছে, তা–ই সন্দেহবশত এটা করা হয়েছে।’ লোকপ্রশাসন বিভাগের নির্বাচন বন্ধের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘ওই নির্বাচনে ভিপি প্রার্থী ফাহাদ আমার সমর্থক। তিনিও মঙ্গলবার আমার সঙ্গে হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন। এ জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার জন্য ফরম বিক্রিতে বাধা দেওয়া হয়েছে। তবে কাউকে গালাগাল করা হয়নি।’
ক্যাম্পাসে প্রতিদিন কর্মসূচির বিষয়ে মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের নেতা সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ পাল্টা হামলা বা অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটাতে নির্দেশ দিয়েছেন। তাই আমাদের সমর্থকেরা প্রতিদিন শান্তিপূর্ণ মিছিল, সমাবেশ করছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো. খোরশেদ আলম বলেন, ‘ক্যাম্পাসে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা বদ্ধ পরিকর। হলগুলোতে বৈধ শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দেওয়ার বিষয়টি জানার পর প্রভোস্টকে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। তিনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন।’
গত মঙ্গলবার ভোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই-বাংলা হলের ৪০১৮ নম্বর কক্ষে ঢুকে ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দীন আহমেদকে বেধড়ক পিটিয়ে ও কুপিয়ে গুরুতর আহত করে হেলমেট ও মুখোশ পরা দুর্বৃত্তরা। এ সময় ওই কক্ষে থাকা মহিউদ্দীনের দুই অনুসারীকেও মারধর করা হয়। তাঁরা বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাতে নগরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করে বন্দর থানা-পুলিশ। গত বুধবার সকালে আহত ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দীন আহমেদ বাদী হয়ে বন্দর থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় সাতজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা সাতজনকে আসামি করা হয়।
গ্রেপ্তার চারজন হলেন আলীম সালেহী, রিয়াজ উদ্দীন মোল্লা ও তাঁদের সহযোগী শামীম সিকদার ও শেখ রেফাত মাহমুদ। এর মধ্যে শেখ রেফাত বহিরাগত এবং বাকি তিনজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রলীগের রাজনীতি করেন। তাঁরা এক সময় হামলার শিকার মহিউদ্দীনের সঙ্গে রাজনীতি করতেন। তাঁরা সবাই বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী।
বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মামলার চার আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।