সাগর আহম্মেদ মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন
সাগর আহম্মেদ মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন

‘তোমার সাগরের জন্য না, লক্ষ সাগরের জন্য দোয়া কোরো, মা’

‘বিকেল সাড়ে পাঁচটার মতো বাজে। ছেলে সাগর ফোনে জানায়, “আব্বু আমাদের এখানকার অবস্থা ভালো না। আমাকে বিকাশে এক হাজার টাকা পাঠাও।” আমি তখন কলাম, মণিরে সাবধানে থাইকো। ফোনের কথা শেষ করেই নারুয়া বাজারে যাই। বিকাশে টাকা পাঠিয়ে সাইকেলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে টাকা পাইছে কি না নিশ্চিত হতে ফোন করি, কিন্তু ফোন আর ধরে না। তখন থেকে আমার বুকটা কেমন যেন করছিল।’

‘মাগরিবের নামাজ শেষ করে সালাম ফেরানোর সময় পকেটের ফোন বাইজা ওঠে। মনটা কেমন যেন আঁতকে ওঠে। আমার মেয়ে মুসমি ফোন করে বলে, “আব্বু বাড়ি আইসো।” বাড়ি আইসা দেখি সব এলোপাতাড়ি। কেউ কিছু বলছে না। বড় ভাইয়ের বড় জামাতা রঞ্জু এদিক-ওদিক করছে। পরে আমার এক নাতি বলছে, বাবাইর (সাগর) মাথায় গুলি লাগছে, হাসপাতালে আছে।’

কথাগুলো বলছিলেন ঢাকার মিরপুর–১০ নম্বর গোলচত্বরে ১৯ জুলাই বিকেলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত সাগরের বাবা কৃষক তোফাজ্জল হোসেন। রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নারুয়া ইউনিয়নের টাকাপোড়া গ্রামের দরিদ্র কৃষক তোফাজ্জল হোসেন। ছেলে সাগর আহম্মেদ (২২) মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ২০ জুলাই সন্ধ্যায় নিজ গ্রামে সাগরের লাশ দাফন করা হয়।

গত রোববার সাগরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একটি চৌচালা টিনের ঘরের এক কক্ষে বাক্‌রুদ্ধ মা গোলাপি বেগম শয্যাশায়ী। আরেক কক্ষে বাবা তোফাজ্জল হোসেন আহাজারি করছেন। সাগরের একমাত্র ছোট বোন মুসমিকে স্বজনেরা বারান্দার একটি কক্ষে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলেন।

সাগরের মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আহাজারিতে ফেটে পড়েন বাবা, মা ও ছোট বোন। গত রোববার দুপুরে বালিয়াকান্দি উপজেলার টাকাপোড়া গ্রামে

স্বজনেরা জানান, সাগরের বোন মুসমি নারুয়া লিয়াকত আলী স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ থেকে আগামী বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। সাগরের স্বপ্ন ছিল বোনকে ঢাকায় নিয়ে কোচিং করাবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন। দুই ভাইবোন একত্রে থাকবেন। মিরপুর–১ নম্বর মাজার রোড এলাকার মেসে চাচাতো বড় ভাই সাইফুল ইসলামের সঙ্গে থাকতেন তিনি।

তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘যখনই কথা হতো তখনই সাগর বলত, “আব্বু তোমাকে আর রোদে পুড়ে মাঠে কাজ করতে হবে না। চাকরি করে তোমাদের ঢাকায় নিয়ে যাব।” আমার মানিক হোটেলে কাজ করত। রাতে মেসে ফেরার সময় কিছু খাবার নিয়ে আসত, রাস্তায় থাকা মানুষকে দিত।’ তিনি জানান, ১৯ জুলাই সকালেও মা–বাবার সঙ্গে সাগরের কথা হয়। ‘সাগর ওর মাকে বলে, “ঢাকার পরিস্থিতি ভালো না। আমার জন্য দোয়া কোরো, আন্দোলনে যাব।” তখন মা বলেছিল, “যেয়ো না বাবা।” তখন আমি (বাবা) বলেছিলাম ও যাবে, না গেলে মুনাফিক হয়ে যাবে। তখন মায়ের কাছে দোয়া চেয়ে সাগর বলে, “মা তোমার সাগরের জন্য না, লক্ষ সাগরের জন্য দোয়া কোরো।”’

১৯ জুলাই জুমার নামাজ শেষে সাগর তাঁর চাচাতো ভাই সাইফুলকে আন্দোলনে যাবে বলে জানান। বারণ করলেও তিনি বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে একাই বের হন বলে জানান তাঁর আরেক চাচাতো ভাই মাসুদ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গোলাগুলির শব্দ পেয়ে সাগরকে ফোন করে পাচ্ছিলেন না সাইফুল। সন্ধ্যার দিকে অজ্ঞাত একজন সাগরের ফোন থেকে সাইফুলকে জানান, সাগর গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তখন এক বন্ধুকে নিয়ে সাইফুল হাসপাতালে খোঁজ করতে থাকেন। পরদিন সকালে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে লাশের স্তূপ থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা খোঁজ করে পরিচয়পত্র দেখে সাগরের লাশ শনাক্ত করেন তাঁরা। দেখা যায়, সাগরের মাথার ডান দিকে গুলি লেগে পেছন দিয়ে বের হয়েছে। পরে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ নিয়ে বিকেলে গ্রামের বাড়ি আসেন তাঁরা।