অবৈধ মজুতবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর নওগাঁর বাজারে ধান ও চালের দাম নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে। তিন দিনের ব্যবধানে নওগাঁর বাজারে প্রতি মণ ধানের দাম কমেছে ৬০ থেকে ২০০ টাকা। আর পাইকারি বাজারে চালের দাম কেজিতে কমেছে ১ থেকে ২ টাকা পর্যন্ত। তবে খুচরা বাজারে এখনো আগের দামেই চাল বিক্রি হচ্ছে।
গুদামে অবৈধ মজুতবিরোধী অভিযানের ভয়ে চালকলমালিক ও ধান আড়তদারেরা স্থানীয় বাজার থেকে ধান-চাল কেনা কমিয়ে দেওয়ায় দাম কমতে শুরু করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। হঠাৎ ধানের দাম প্রতি মণে ৬০ থেকে ৭০ টাকা কমে যাওয়ায় হতাশ কৃষকেরা।
নওগাঁর আলুপট্টি চাল মোকামের ব্যবসায়ী দ্বিজেন চন্দ্র ঘোষ বলেন, মজুতবিরোধী অভিযান শুরুর পর মোকামে চাল কেনাবেচা নেই বললেই চলে। আগে যেখানে একেকটা আড়ত থেকে প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় ট্রাক চাল বিক্রি হতো। এখন সেখানে একটি ট্রাকও বিক্রি হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে অনেক ব্যবসায়ী কম দামে চাল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ, গুদামে চালের মজুত পেলে যেকোনো মুহূর্তে জরিমানা গুনতে হতে পারে।
গত মঙ্গলবার থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত নওগাঁর বিভিন্ন উপজেলায় অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে ধান-চাল মজুতের দায়ে ১৫ জন ব্যবসায়ীকে ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
নওগাঁর অন্যতম বড় ধানের মোকাম নিয়ামতপুর উপজেলার ছাতড়া বাজার। এ বাজারে সপ্তাহে প্রতিদিন ধান কেনাবেচা হয়। আজ শুক্রবার বাজারের আড়তদার ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি মণ মোটা জাতের স্বর্ণা-৫ ও স্বর্ণা-৫১ (হাইব্রিড স্বর্ণা) ধান মানভেদে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিন দিন আগেও এসব ধান বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ২৬০ থেকে ১ হাজার ২৭০ টাকা মণ। বোরো মৌসুমের সরু জাতের জিরা ও কাটারি ধান বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩২০ থেকে ১ হাজার ৩৩০ টাকায়। তিন দিন আগে প্রতি মণ জিরা ও কাটারি ধানের দাম ছিল ১ হাজর ৪৫০ থেকে ১ হাজার ৪৬০ টাকা।
মেসার্স আসিফ ট্রেডার্স নামের ধান আড়তের মালিক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, বর্তমানে বাজারে ধানের দাম পড়তি। মোটা জাতের প্রতি মণ ধানের দাম তিন-চার দিনের ব্যবধানে ৬০ থেকে ৭০ টাকা কমে গেছে। দাম কমার প্রধান কারণ হলো, মিলাররা ধান কিনছেন না। আগে যেখানে প্রতিদিন একটি আড়ত থেকে পাঁচ থেকে ছয় ট্রাক ধান কেনা হতো, এখন সেখানে দিনে এক ট্রাকও ধান কেনা হচ্ছে না। মিলারদের চাহিদা না থাকায়, তাঁরাও ধান কিনছেন না। কারণ, বেশি ধান কিনে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি মজুত হয়ে গেলে জরিমানা দিতে হতে পারে। এই ভয়ে ধান কেনা কমিয়ে দিয়েছেন।
জেলায় সবচেয়ে বেশি সরু জাতের সুগন্ধি ধান চাষ হয় মহাদেবপুরে। মাতাজীহাট বাজারের আড়তদার ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিন দিনের ব্যবধানে চিনিগুঁড়া জাতের সুগন্ধি ধানের দাম প্রতি মণে কমেছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। প্রতি মণ চিনিগুঁড়া ধানের আজকের বাজারদর ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৩৫০ টাকা। তিন দিন আগে দাম ছিল ২ হাজার ৫০০ টাকা। বাজারের আড়তদার সোহেল রানা বলেন, ‘মিলাররা প্রশাসনের অভিযানের ভয়ে মিলে ধান নিচ্ছেন না। এই পরিস্থিতিতে আমরাও ধান কমিয়ে দিয়েছি।’
মহাদেবপুর উপজেলার সারথা গ্রামের কৃষক আকবর আলী বাজারে এসেছিলেন ধান বিক্রি করতে। কত দামে ধান বিক্রি করলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে মলিন মুখে তিনি বলেন, ‘আর কইয়েন না ভাই। গত রোববারই এই বাজারে প্রতি মণ চিনিগুঁড়া ধান বিক্রি করে গেছি ২ হাজার ৫০০ টাকায়। আজকে সেই ধান বিক্রি করতে হলে ২ হাজার ৩০০ টাকায়। চার দিনের মধ্যে ২০০ টাকা নাই হয়ে গেছে। এভাবে ধানের দাম ওঠা-নামা করলে ক্যামনে চলবে।’
নওগাঁর আলুপট্টি মোকাম ও মহাদেবপুর উপজেলা সদরের বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) মোটা ও সরু জাতের চালের দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। আর আতপ চালের দাম বস্তায় কমেছে ১০০ টাকা পর্যন্ত।
নওগাঁ জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। কৃষক ও ভোক্তা—উভয়ই যেন স্বস্তিতে থাকতে পারেন, সেদিকে সরকারকে নজর দিতে হবে।