জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলে নির্যাতন ও শরীরে মদ ঢেলে মাদকাসক্ত হিসেবে প্রমাণ করারও চেষ্টা চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ছাত্রলীগের এক নেতা। এ ঘটনা কাউকে না জানাতে পেটে পিস্তল ঠেকিয়ে হুমকিও দেওয়া হয়।
আজ বুধবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এসব বর্ণনা দেন ছাত্রলীগের ওই নেতা। তাঁর নাম জাহিদ হাসান ওরফে ইমন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির (আইআইটি) ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের (৪৬তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী। শেখ রাসেল হলের আবাসিক ছাত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের উপতথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক।
সংবাদ সম্মেলনে অভিযুক্ত হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের (৪১তম ব্যাচ) সাবেক শিক্ষার্থী আরমান খান (যুব), ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের (৪২তম ব্যাচ) মো. আরাফাত, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের (৪৪তম ব্যাচ) তুষণ ও অজ্ঞাত আরেক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন জাহিদ হাসান।
এর মধ্যে আরমান খান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খানের ছোট ভাই। কয়েক বছর আগে ছাত্রত্ব শেষ হলেও তিনি মওলানা ভাসানী হলের ১২৬ নম্বর চারজনের কক্ষ একাই দখল করে থাকেন। এর আগেও ওই কক্ষে কয়েকজন বহিরাগতকে নিয়ে মারধর ও নির্যাতনের অভিযোগ আছে আরমানের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল আরমানের ইশারায় চলেন বলে ক্যাম্পাসে গুঞ্জন রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, জাহিদ সাভারের রেডিও কলোনিতে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। ১৩ আগস্ট বাড়ির মালিক মো. শিমুলের সঙ্গে তাঁর কথা–কাটাকাটি হয়। ওই ঘটনার জেরে ধরে সেদিন রাতেই জাহিদকে ফোন দিয়ে আরমান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন বাড়ির মালিকের পূর্বপরিচিত আরাফাত। এর পরিপ্রেক্ষিতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে, জাহিদকে মওলানা ভাসানী হলের ১২৬ নম্বর কক্ষে যেতে বলেন তিনি। রাত ১২টার দিকে জাহিদ ১২৬ নম্বর কক্ষে ঢুকতেই ঘুষি দিয়ে জাহিদের নাক ফাটিয়ে দেন আরমান খান। তখন যাতে চিৎকার করতে না পারেন, তাই জাহিদের মুখ বেঁধে দেন আরাফাত। পরে আরমান, আরাফাতসহ সেখানে উপস্থিত অন্য অভিযুক্তরা জাহিদকে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকেন। এ সময় জাহিদ তাঁদের কাছে কাকুতিমিনতি করেও কোনো প্রতিকার পাননি। তাঁকে এক দফা মারধরের পর ইয়াবা সেবন করেন আরমান। পরে আবারও জাহিদের ওপর নির্যাতন শুরু করেন তাঁরা। এ ছাড়া জাহিদের শরীরে মদ ঢেলে উল্লাস করতে থাকেন আরমান খান ও তাঁর সহযোগীরা।
এরপর রাত তিনটার দিকে জাহিদকে হলের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে নিয়ে যান তুষণ। তখন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেলকে গালিগালাজ করেছেন বলে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নিয়ে মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করেন তুষণ। এরপর তাঁকে আবার ১২৬ নম্বর কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন আরমান খান পিস্তল বের করে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেন। কিছুক্ষণ পর আকতারুজ্জামান সোহেল সেখানে গিয়ে জাহিদ হাসানকে বাইরে নিয়ে গিয়ে বিষয়টি সমাধানে আশ্বস্ত করে হল থেকে চলে যেতে বলেন।
এর আগে মওলানা ভাসানী হলের ১২৬ নম্বর কক্ষে যাওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসানকে অবহিত করেন জাহিদ। পরদিন ১৪ আগস্ট সকালে মারধরের ঘটনার বিষয়টি জানাতে প্রক্টরের বাসায় যান তিনি। জাহিদ সেখানে গিয়ে দেখেন ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত রয়েছেন। প্রক্টরের সঙ্গে কথা বলা শেষে আকতারুজ্জামান সোহেল জাহিদকে মওলানা ভাসানী হলের অতিথি কক্ষে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলেন। তখন জাহিদ আকতারুজ্জামানকে শরীরে মারধরের দাগ দেখালে কিছু না বলে সেখান থেকে চলে যান।
এরপর জাহিদ ঘটনাটি আল নাহিয়ান খান জয় এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতাকে জানান। তখন জয় তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। অভিযুক্ত আরমান ভুক্তভোগী জাহিদকে আরও ক্ষতি করতে পারেন বলে জানিয়ে নিরাপত্তার স্বার্থে কিছুদিন বাইরে থেকে ঘুরে আসার পরামর্শ দেন জয়। এরপর সাত দিন জয়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তিনি সাড়া পাননি।
জাহিদ হাসান বলেন, ‘সেদিনের ঘটনার পর থেকে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করায় আমি প্রচণ্ড দুর্বলতা অনুভব করি। রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুমাতে পারি না। আমার আত্মসম্মান সব শেষ হয়ে গেছে। আমি সেদিনের ঘটনাটি সবাইকে জানিয়ে আত্মহত্যা করতে চাই। আমি এর আগেও কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি, কিন্তু শক্তি পাইনি। সর্বশেষ গতকাল দুপুরে ফেসবুকে লাইভে গিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি।’
মারধর–পরবর্তী নানা ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের ওপর থেকে ভরসা উঠে গেছে বলে জানান জাহিদ হাসান। পাশাপাশি নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দেননি বলে দাবি তাঁর।
এ বিষয়ে জানতে আরমান খান ওরফে যুব এবং আতিকুজ্জামানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে এবং খুদে বার্তা পাঠিয়েও তাঁদের সাড়া পাওয়া যায়নি। আরেক অভিযুক্ত আরাফাত মারধরের ঘটনা অস্বীকার করেছেন। প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাহিদ আমাদের ছোট ভাই। তাঁকে মারধর কেন করব। সে সাভারে একটি বাসায় ঝামেলায় পড়েছিল। তাই আমরা যুব (আরমান খান) ভাইয়ের রুমে ডেকে তাকে বিষয়টি বুঝিয়ে সমাধান করতে বলি। বিষয়টি সমাধানও হয়েছিল। এখন কেন সংবাদ সম্মেলন করল বুঝতে পারছি না।’
এ বিষয়ে প্রক্টর ফিরোজ-উল-হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাহিদকে আরমান মারধর করেছে, বিষয়টি সে আমাকে অবগত করেছিল। তবে সে কোনো অভিযোগ দেয়নি। সে আমাকে বলেছে মারধরের বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করবে। কেউ যদি বিচার না চায় এবং রাজনৈতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করে, তাহলে আমাদের কী করার আছে।’
মওলানা ভাসানী হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক হুসাইন মো. সায়েম বলেন, ‘হলের ১২৬ নম্বর কক্ষে সাবেক শিক্ষার্থীরা থাকে, সে বিষয়টি আমি জানি। আমি এ বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তবে মারধরের ঘটনা আমি জানি না।’