প্রচারণা শুরুর পর প্রতিপক্ষের হাতে ক্যাম্প ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অন্তত ১০টি ঘটনা ঘটেছে।
নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, নওগাঁয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ততই উত্তেজনা বাড়ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারণা শুরুর পর প্রতিপক্ষের হাতে নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অন্তত ১০টি ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া তিনটি সশস্ত্র হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
এসব ঘটনা শুধু নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন নয়, ফৌজদারি অপরাধও। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এসব ক্ষেত্রে খুব একটা তৎপর ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না।
আমরা নির্বাচনী পরিবেশ ঠিক রাখতে সচেষ্ট রয়েছি। ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে কাউকেই ছাড় দেব না।গোলাম মওলা, রিটার্নিং কর্মকর্তা
সোমবার পর্যন্ত নওগাঁর ছয়টি সংসদীয় আসনের মধ্যে পাঁচটিতেই নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও প্রতিপক্ষের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও নেতা–কর্মীরা হামলার শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর অনুসারী নেতা–কর্মীরা ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। তবে কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাও স্বতন্ত্র প্রার্থীর অনুসারী নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে তাঁদের নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ করেছেন।
১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের দিনই নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর ও বদলগাছী) আসনে মহাদেবপুর উপজেলার মাতাজীহাট ও খোর্দকালনা এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দিন তরফদারের নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর হয় এবং তাঁর ছেলে সাকলাইন আহমেদসহ ১০ কর্মী মারধরের শিকার হন। ছলিম তরফদারের অনুসারী কর্মী-সমর্থকদের অভিযোগ আওয়ামী লীগের প্রার্থী সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুসারী নেতা–কর্মীরা এসব ঘটনা ঘটিয়েছেন। মারধরের ঘটনায় থানায় ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ করা হলেও থানা–পুলিশকে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
স্বতন্ত্র প্রার্থী ছলিম উদ্দিন তরফদারের ছেলে সাকলাইন আহমেদ রকি বলেন, ‘১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মহাদেবপুর উপজেলার মাতাজীহাট এলাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর অনুসারী নেতা–কর্মীরা আমার ওপর হামলা করে। হামলাকারীরা মাতাজীহাটে আমাদের ট্রাক প্রতীকের নির্বাচনী ক্যাম্পও ভাঙচুর করে। এ ছাড়া ২৩ ডিসেম্বর রাতে মহাদেপুর উপজেলার সফাপুর এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গেলে আমার বাবার ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় থানা ও রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।’
তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর ও কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুসারী মহাদেবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে প্রচার কার্যক্রম চালাচ্ছি। আমার বিরুদ্ধে সহিংসতার যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।’
নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হামলার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ উঠেছে নওগাঁ-১ (নিয়ামতপুর, পোরশা ও সাপাহার) আসনেও। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। এখানে তাঁর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন নিয়ামতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য খালেকুজ্জামান তোতা।
২১ ডিসেম্বর রাতে পোরশা উপজেলার তাঁতিপাড়া মোড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী খালেকুজ্জামানের ট্রাক প্রতীকের নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর ও তাঁর কর্মী-সমর্থকদের মারধর করা হয়েছে বলে থানায় অভিযোগ করা হয়। অন্যদিকে সাধন চন্দ্র মজুমাদারের অনুসারীদের অভিযোগ, ট্রাকের প্রার্থীর লোকজন ওই দিন রাতে নৌকার নির্বাচনী ক্যাম্প আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।
নওগাঁ-৪ (মান্দা) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্রহানী সুলতান মামুদের নির্বাচনী ক্যাম্প, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও তাঁর কর্মীদের মারধরের অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নাহিদ মোর্শেদের অনুসারী নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে। ২৩ ডিসেম্বর উপজেলার মৈনম বাজারে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হওয়ার পর পুলিশ আওয়ামী লীগ প্রার্থীর অনুসারী তিন কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে।
২৪ ডিসেম্বর রাতে নওগাঁ-৫ (নওগাঁ সদর) আসনের নির্বাচনী এলাকা নওগাঁ পৌরসভার কালীতলা ও বক্তারপুর এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর তিনটি নির্বাচনী ক্যাম্প পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের অভিযোগ, স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান ছেকার আহমেদের অনুসারী নেতা–কর্মীরা তাঁদের ক্যাম্প আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।
সর্বশেষ গত সোমবার নওগাঁ-৬ (রানীনগর ও আত্রাই) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ওমর ফারুক সমুন ও তাঁর কর্মী-সমর্থকদের ওপর চার দফা হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ওমর ফারুকসহ সাতজন আহত হয়েছেন। ওমর ফারুকের অভিযোগ, ‘আওয়ামী লীগের প্রার্থী সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেনের ছেলে রাহিদ ও তাঁর অনুসারী নেতা–কর্মীরা তাঁদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। এ ঘটনায় পুলিশ ও রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করার পরও কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।’ তবে আনোয়ার হোসেনের দাবি, স্বতন্ত্র প্রার্থীর লোকজনই তাঁর কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা করেছে।
নির্বাচনী সহিংসতার বিষয়ে জানতে চাইলে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নওগাঁর জেলা প্রশাসক মো. গোলাম মওলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনী পরিবেশ ঠিক রাখতে সচেষ্ট রয়েছি। যখনই কোনো সহিংসতার খবর পাচ্ছি, সেখানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে আমরা কাউকেই ছাড় দেব না।’
নওগাঁর ছয়টি সংসদীয় আসনের সব কটিতেই নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। কোনো কোনো আসনে নিজ দলের একাধিক প্রার্থীর সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে নৌকার প্রার্থীকে। ছয়টি আসনের মধ্যে নওগাঁ-৩ ও নওগাঁ-৪ আসনে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বর্তমান সংসদ সদস্যের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে নৌকার প্রার্থীকে।