মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় বিভিন্ন স্থান থেকে রেললাইনের দুই পাশের সেগুন, রেইনট্রিসহ বিভিন্ন জাতের ছোট-বড় গাছ কেটে নিয়েছেন দুর্বৃত্তরা। নির্মাণাধীন কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইনের বিভিন্ন স্থানে এ ঘটনা ঘটেছে। গাছ কাটার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা স্থানীয়ভাবে রেলওয়ের অনুমতি নিয়ে গাছ কাটছেন—এমন মিথ্যে প্রচারণা চালিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন।
এদিকে অবৈধভাবে গাছ কাটার ঘটনাটি ধরা পড়ার পর পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গাছ কাটার ঘটনায় রেলওয়ের পক্ষ থেকে বড়লেখা থানায় একটি মামলা হয়েছে। বড়লেখা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইয়ারদৌস হাসান অবৈধভাবে গাছ কাটা ও একজনের গ্রেপ্তারের বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইনের বড়লেখা অংশের বিভিন্ন স্থান থেকে দুর্বৃত্তরা প্রায় ২০০ গাছ কেটে বিক্রি করেছেন। বড়লেখা রেলস্টেশন, কাঠালতলী স্টেশন, দক্ষিণভাগ স্টেশন ও রতুলী এলাকায় সেগুন, বড় রেইনট্রি, কাঁঠাল, একাশিয়াগাছ কাটা হয়েছে। স্টেশন এলাকার বাইরের অংশেও গাছ কাটা হয়েছে।
রেলওয়ে গাছ কাটতে কাউকে অনুমোদন দেয়নি। তাঁরা অবৈধভাবে গাছ কাটছিলেন। প্রকল্পের কাজ ধীরে হচ্ছে। লোকজন কম থাকে, এই সুযোগে তাঁরা গাছ কেটেছেন।জাকির হোসাইন, ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্বে), কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্প
কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইন পুরোনো হয়ে যাওয়ায় তা তুলে ফেলে নতুন রেললাইন বসানো হচ্ছে। এ নির্মাণকাজের দায়িত্বে রয়েছে টেক্সমাকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। তারা জানায়, ১ আগস্ট বড়লেখা উপজেলার রতুলী এলাকায় অনেকগুলো গাছ কাটা হলে বিষয়টি টেক্সমাকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের লোকজনের নজরে আসে। এরপর ওই দিনই টেক্সমাকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের স্থানীয় কাজের তদারকি ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেফটি কর্মকর্তা পীযুষ দেবনাথ কামাল উদ্দিন (৪৫) নামের একজনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা সাত-আটজনকে অভিযুক্ত করে বড়লেখা থানায় মামলা করেন। পুলিশ সেদিন রাতেই কামাল উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে। কামাল উদ্দিনের বাড়ি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, নির্মাণ কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের চুক্তি হচ্ছে, কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইন নির্মাণ শেষে রেললাইন ও এর দুই পাশের গাছপালা বাংলাদেশ রেলওয়েকে বুঝিয়ে দিতে হবে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ, কাঠালতলী ও বড়লেখা রেলস্টেশন এলাকা থেকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা রেললাইনের পাশে রেলওয়ের জায়গায় থাকা গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। সর্বশেষ গত ১ আগস্ট বেলা একটার দিকে বড়লেখা উপজেলার রতুলী রেলওয়ে ব্রিজ নম্বর-২৪৭ এলাকা থেকে কামাল উদ্দিনসহ ৭-৮ ব্যক্তি শ্রমিক নিয়ে ২৮টি একাশিয়াগাছ কেটে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। বিষয়টি দেখে বাদীসহ (সেফটি কর্মকর্তা) তাঁর কার্যালয়ের লোকজন কামাল উদ্দিনকে গাছ কাটার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, তিনি রেলওয়ের লোক। রেলওয়ের অনুমতি নিয়ে গাছ কাটছেন। এরপর সেফটি কর্মকর্তা পীযুষ দেবনাথ তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে গাছ কাটার বিষয়টি জানান। কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের কেউ গাছ কাটছেন না। গাছ কাটার বিষয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো তথ্য নেই।
সেফটি কর্মকর্তা পীযুষ দেবনাথ গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সংবাদ পাই রতুলীতে গাছ কেটে নিচ্ছে। এখানে রেলওয়ের পক্ষে আমরা (টেক্সমাকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড) দায়িত্বে আছি। গাছ কাটাসহ কোনো কিছু হলে রেলওয়ে থেকে আমাদের জানানোর কথা। কামাল উদ্দিন নামের ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ে সব জানে। তিনি নিজেকে কন্ট্রাক্টর দাবি করেন।’ পীযুষ দেবনাথ বলেন, ‘আমরা দায়িত্বে আছি, আমাদের জবাবদিহি করতে হয়। এরপর আমরা রেলওয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। মামলা করি।’
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বড়লেখা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হাবিবুর রহমান গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘রতুলী এলাকায় ২৮টি গাছ ছাড়াও তাঁরা আগে আরও গাছ কেটেছেন। রেলওয়ের অনুমোদন নিয়ে কাটার কথা বলেছেন। কিন্তু অনুমোদনের কাগজ দেখাতে পারেননি। রেলওয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে, রেলওয়ে কোনো নিলাম বা অনমুতি দেয়নি। রেলওয়ে কর্মচারীদের যোগসাজশে তাঁরা এ কাজ করেছেন।’
কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্পের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (কার্য) জাকির হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এর আগেও দুষ্কৃতকারীরা রেলওয়ের লোহার পাত চুরি, অবৈধভাবে গাছ কেটেছে। থানায় অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকেই গাছ কেটে আসছিল দুষ্কৃতকারীরা। কিন্তু ধরা যাচ্ছিল না। এবার হাতেনাতে ধরা হয়েছে, মামলা হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী লোকের যোগসাজশে তাঁরা গাছ কাটছিলেন।’ ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী বলেন, রেলওয়ে গাছ কাটতে কাউকে অনুমোদন দেয়নি। তাঁরা অবৈধভাবে গাছ কাটছিলেন। প্রকল্পের কাজ ধীরে হচ্ছে। লোকজন কম থাকে, এই সুযোগে তাঁরা গাছ কেটেছেন।