রংপুরে দিনভর সূর্যের দেখা নেই। তীব্র শীতে কাতর মানুষ। হাড়কাঁপানো শীত থেকে রক্ষা পেতে বাজারের ব্যবসায়ীরা কাঠ জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছেন। রংপুর নগরের সিও বাজারে গতকাল
রংপুরে দিনভর সূর্যের দেখা নেই। তীব্র শীতে কাতর মানুষ। হাড়কাঁপানো শীত থেকে রক্ষা পেতে বাজারের ব্যবসায়ীরা কাঠ জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছেন। রংপুর নগরের সিও বাজারে গতকাল

পঞ্চগড় ও নীলফামারী

কনকনে শীতে বিপর্যস্ত জীবন

টানা তিন দিন ধরে দেখা নেই সূর্যের। উত্তরের হিমেল বাতাস আর ঘন কুয়াশায় বাইরে থাকা দায়। 

বৃহস্পতিবার বেলা দুইটা। আকাশে মেঘ আর ঘন কুয়াশায় দেখা নেই সূর্যের। উত্তরের হিমেল বাতাসে অনুভূত হচ্ছে কনকনে শীত। ঠিক সেই সময় পঞ্চগড় জেলা শহরসংলগ্ন পৌর খালপাড়া এলাকার বালুমহালে করতোয়া নদীর হিমশীতল পানিতে নেমে নৌকায় বালু তুলছেন মো. দুলাল (৪০) ও হামিদুল ইসলাম (৩৮) নামে দুই শ্রমিক। তাঁদের পরনে টি–শার্ট আর আর হাফপ্যান্ট। তবে শীত থেকে রক্ষা পেতে দুজনই মাথায় পড়েছেন টুপি আর গলায় পেঁচিয়েছেন মাফলার।

দুলাল আর হামিদুলের বাড়ি পঞ্চগড় সদর উপজেলার গারিনাবাড়ি ইউনিয়নের বজরাপাড়া-নতুনহাট এলাকায়। প্রতিদিন সকালে এসে জেলা শহরসংলগ্ন করতোয়া নদীতে নেমে এভাবেই বালু তুলে জীবিকা নির্বাহ করেন তাঁরা। শীতের প্রসঙ্গে দুলাল বলেন, ‘হামেরা গরিব লোক, কাজ করে তো খাবাই নাগিবে। ঠান্ডার সময় হামার কষ্ট বেশি, নদীত বালু না উঠাইলে হামার ইনকাম বন্ধ। ঠান্ডা পানিখানোত নামিলে মনে হচে হাত-পাও লা অবশ হয় যাছে।’

পঞ্চগড় ও নীলফামারীতে টানা তিন দিন ধরে দেখা নেই সূর্যের। উত্তরের হিমেল বাতাস আর ঘন কুয়াশায় প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। হাসপাতালে বাড়ছে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের ভিড়।

পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীর বালু ও পাথরশ্রমিকদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষেরা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন। জেলার বিভিন্ন নদী থেকে বালু উত্তোলন করে প্রায় ১২ হাজার শ্রমিক জীবিকা নির্বাহ করেন বলে জানা গেছে। গতকাল করতোয়া নদীতে নেমে একটি নৌকায় জাল দিয়ে নুড়িপাথর তুলছিলেন মো. আলিউদ্দিন (৪৩)। তিনি বললেন, ‘তিন দিন তকা (থেকে) বেলা দেখা যায় না। নদীত ঠান্ডা পানিখানোত নামে পাথর উঠাইতে খুপে কষ্ট হচে। কিন্তু করিবেন পেট তো আর ঠান্ডা বুঝে না। কনেক (একটু) রোদ উঠিলে হামার কাজ করিতে আরাম হবে।’

তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় তেঁতুলিয়ায় দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে ২ জানুয়ারি থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত পঞ্চগড়ে মৃদু ও মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে। এরপর তাপমাত্রা বাড়লেও টানা তিন দিন দেখা মিলছে না সূর্যের। 

তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রাসেল শাহ মুঠোফোনে বলেন, গত কয়েক দিনের তুলনায় তেঁতুলিয়ার তাপমাত্রা সামান্য বাড়লেও আকাশে মেঘ আর ঘন কুয়াশার কারণে সূর্যের তীব্রতা ভূপৃষ্ঠে ছড়াতে পারছে না। এতে দিনের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যবধানও কমে গেছে। সেই সঙ্গে উত্তরের হিমশীতল বাতাসের পরিমাণও বেড়েছে। বাতাসে আর্দ্রতা বেশি। এ জন্য এই এলাকায় বেশি শীত অনুভূত হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে বাড়তে থাকে কুয়াশার দাপট। টিপটিপ বৃষ্টির মতো ঝরা কুয়াশায় ভিজে যায় পিচঢালা পথ। সকালে ঘন কুয়াশার কারণে সড়কে চলাচল করা যানবাহনগুলোকে চালাতে হয় হেডলাইট জ্বালিয়ে। কেউ খড়কুটো জ্বালিয়ে করছেন শীত নিবারণের চেষ্টা। রিকশাচালক বয়জুল ইসলাম বলেন, ‘তিন দিন তকা কুহাকাপ (অতিরিক্ত) ঠান্ডা। বাতাসখান শীলশীল করে নাগেছে। হাত-পাও লা ককোড়া হয়ে আসেচে। নাক-চোখ দিয়ে পানি বাইর হচে। ঠান্ডাখানোত রিকশাখান চালাইলে শরীলডা কাপেছে।’

টানা কয়েক দিনের কনকনে শীতে পঞ্চগড়ে বেড়েছে ঠান্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা জ্বর, সর্দি, কাশি, ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন বলে জানা গেছে।

সিভিল সার্জন মোস্তফা জামান চৌধুরী বলেন, কয়েক দিন ধরে হাসপাতালে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। হাসপাতালে আসা রোগীদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা বেশি। শীতের এ সময়টাতে বয়স্ক ও শিশুদের ক্ষেত্রে বাড়তি যত্ন নিতে হবে। বিশেষ করে শিশুদের যেন কোনোভাবেই ঠান্ডা না লাগে, সে বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে। বাসি খাবার এড়িয়ে চলতে হবে এবং গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। রোটা ভাইরাসের টিকা নিতে পারলে আরও ভালো। সেই সঙ্গে মৌসুমি ভাইরাসজনিত রোগব্যাধি এড়াতে ফলমূল বেশি খেতে হবে।

জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, পঞ্চগড় জেলার শীতার্ত মানুষের জন্য এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে ২৮ হাজার ৪৫০টি কম্বল বিতরণ করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ২ জানুয়ারি নীলফামারীতে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল চারটা পর্যন্ত সূর্যের দেখা মেলেনি। সকাল থেকে মাঠেঘাটে কৃষিশ্রমিকদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। অনেকে শীতবস্ত্র কিনতে পুরোনো কাপড়ের বাজারে ভিড় জমাচ্ছেন।

হাড়কাঁপানো শীতে পানিতে নেমে পাথর তুলছেন একজন শ্রমিক। পঞ্চগড়ের পৌর খালপাড়া এলাকার করতোয়া নদীতে গতকাল

সৈয়দপুর আবহাওয়া কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লোকমান হাকিম জানান, বৃহস্পতিবার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন বুধবার ছিল ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সব মিলিয়ে শীতে জবুথবু এখানকার লোকজন।

জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ বলেন, ইতিমধ্যে জেলার ছয় উপজেলায় ৪০ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। সরকারিভাবে বরাদ্দের জন্য নতুন করে চাহিদা পাঠানো হয়েছে।

ইটাখোলা ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের একটি বাগানবাড়িতে কাজ করছিলেন টেপা রায় (৭০)। তিনি বলেন, ‘খিব ঠান্ডা পইড়ছে বাও। তিন দিন বেলা ওঠেছে না। অগুনের গোড়ত বইসলে উঠির মনায় না। কাম না কইরলে খামো কি? এই জন্য এই ঠান্ডাত কাম করির নাগেছে।’

[প্রতিবেদন তৈরি করতে তথ্য দিয়েছেন প্রতিনিধি, পঞ্চগড়, নীলফামারীসৈয়দপুর]