রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

অছাত্র, শিক্ষার্থী নির্যাতনে অভিযুক্তদের হাতেই ছাত্রলীগের নেতৃত্ব

ছাত্রলীগ
ছাত্রলীগ

সম্মেলনের এক মাস পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ৩৯ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় কমিটি। নতুন এই কমিটির সাধারণ সম্পাদক থেকে শুরু করে একাধিক নেতার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী নির্যাতন, চাঁদাবাজি, সিট–বাণিজ্যের মতো বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। নিয়মিত ছাত্রত্ব শেষ হওয়া নেতারাও পেয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ পদ। এ ছাড়া সাংগঠনিকভাবে দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকা কয়েকজনও পদ পেয়েছেন।

মোস্তাফিজুর রহমানকে সভাপতি ও আসাদুল্লা-হিল-গালিবকে সাধারণ সম্পাদক করে গতকাল শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে এক বিজ্ঞপ্তিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় কমিটি। আগামী এক বছরের জন্য অনুমোদিত এই আংশিক কমিটিতে ২০ জনকে সহসভাপতি করা হয়েছে। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আছেন আটজন। সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পেয়েছেন ৯ জন। তাঁদের মধ্যে অন্তত চারজনের নিয়মিত ছাত্রত্ব নেই। শিক্ষার্থী নির্যাতন, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আছে অন্তত সাতজনের বিরুদ্ধে।

ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণার পর ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নির্যাতন ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাঁদের অনেকেই ছাত্রলীগের কমিটিতে পদ পেয়েছেন। ছাত্রলীগের অনেক মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে থেকে নেতৃত্ব বাছাই করা যেত। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে হয় সঠিক তথ্য নেই অথবা তাঁদের অসৎ কোনো উদ্দেশ্য আছে।

জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘ প্রায় সাত বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়া হয়েছে। যাঁরা ঢালাওভাবে অভিযোগ করছেন, তাঁদের যদি সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য–প্রমাণ থাকে, দিতে পারেন। আমরা খতিয়ে দেখব।’

সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন কমিটির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁর শিক্ষাজীবন শেষ হয়েছে। তবে তিনি ছাত্রত্ব ধরে রাখতে ভর্তি হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব আদার ল্যাঙ্গুয়েজের একটি শর্ট কোর্সে। মাঝে কিছু সময় তাঁকে ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব

কমিটির সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ-হিল-গালিব আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রথম বর্ষে উত্তীর্ণ হলেও দ্বিতীয় বর্ষ আর টপকাতে পারেননি। পরে ড্রপআউট হয়ে ছাত্রত্ব হারিয়েছেন তিনি। ছাত্রত্ব দেখাতে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভুয়া সনদ’ দেখিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে সন্ধ্যাকালীন মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হয়েছেন তিনি।

গালিব ঢাকার উত্তরায় অবস্থিত ‘অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের’ বিবিএ পাসের একটি সনদপত্র দিয়ে সন্ধ্যকালীন মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হন। গত ৩ সেপ্টেম্বর বিভাগের সভাপতি মুসতাক আহমেদ বরাবর অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কামরান চৌধুরীর পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, আসাদুল্লাহ-হিল-গালিব ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেননি। এমনকি তিনি যে রেজিস্ট্রেশন নম্বরের সনদ জমা দিয়েছেন, সেটি ভুয়া এবং অসত্য।

অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কামরান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাবির সংশ্লিষ্ট বিভাগ আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল, বিষয়টি সত্যি নাকি মিথ্যা। আমরা ওই বিভাগকে আমাদের উত্তর জানিয়ে দিয়েছি।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হয়েও গালিব অবৈধভাবে মাদার বখশ হলে থাকেন। জানতে চাইলে সব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন দাবি করে আসাদুল্লাহ-হিল-গালিব বলেন, ‘এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা এসব ছড়াচ্ছে।’

শিক্ষার্থী নির্যাতনে অভিযুক্তরা বড় পদে

এক ছাত্রকে তিন ঘণ্টা কক্ষে আটকে রেখে মারধরের অভিযোগ রয়েছে মতিহার হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহার বিরুদ্ধে। নির্যাতনে এক কানের পর্দা ফেটে যায় ভুক্তভোগী অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সামছুল ইসলামের। গত বছরের ১৯ আগস্টের এই ঘটনায় দেওয়া লিখিত অভিযোগে সামছুল উল্লেখ করেছিলেন, ভাস্কর সাহা হুমকি দিয়ে তাঁকে বলেন, কাউকে বললে আবরারের যে অবস্থা হয়েছে, সেই অবস্থা হবে। নতুন কমিটিতে ভাস্কর সাহা পেয়েছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ।

শিক্ষার্থীকে কক্ষে আটকে নির্যাতনকারী ছাত্রলীগ নেতা ভাস্কর সাহার শাস্তির দাবিতে শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন

চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে সোহরাওয়ার্দী হলে প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নাঈম আলীর বিরুদ্ধে। শিক্ষার্থী নির্যাতনে অভিযুক্ত এই নেতাকে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করেছে শৃঙ্খলা কমিটি। তিনিও নতুন কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন।

গত ১ আগস্ট শেরেবাংলা একে ফজলুল হক হলে এক ছাত্রলীগ নেতাকে মেরে কানের পর্দা ফাটানোর অভিযোগ উঠে দুই নেতার বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী নজরুল ইসলাম ছিলেন ওই হল শাখা ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক। আমীর আলী হল শাখা ছাত্রলীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক আল আমিন ও বঙ্গবন্ধু হল শাখার সাধারণ সম্পাদক আলফাত সায়েম ওরফে জেমসের বিরুদ্ধে মারধরের এই অভিযোগ উঠেছিল। আলফাত সায়েম নতুন কমিটিতে সহসভাপতি হয়েছেন।

গত বছরের ১২ আগস্ট ছাত্রলীগের তিন নেতার বিরুদ্ধে শহীদ হবিবুর রহমান হলের সামনের একটি দোকানের ক্যাশবাক্স থেকে ৫০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠে। অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন শহীদ জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রাশেদ খান, শহীদ হবিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সামিউল আলম ওরফে সোহাগ এবং ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু সিনহা। এর মধ্যে সামিউল আলম নতুন কমিটিতে সহসভাপতি পদ পেয়েছেন।

নবাব আবদুল লতিফ হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম হোসেনের বিরুদ্ধে হলে শিক্ষার্থীকে নির্যাতন, সিলগালা কক্ষ ভাঙচুরের অভিযোগ রয়েছে। তিনিও পেয়েছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ। শহীদ শামসুজ্জোহা হলের সাধারণ সম্পাদক মো. মোমিন ইসলাম নতুন কমিটির সহসভাপতি হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে হলে সিট বাণিজ্য, শিক্ষার্থী নির্যাতন ও এক হল কর্মচারীকে চাঁদার দাবিতে প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগ রয়েছে।

ছাত্রত্ব শেষ হওয়ায় রহমতুন্নেছা হল ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না আক্তারকে গত ২১ সেপ্টেম্বর হল ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিল প্রশাসন। কিন্তু নির্দেশনা অমান্য করে পরদিন বিকেলে উল্টো হল গেটে তালা দেন তামান্না ও ছাত্রলীগের নেত্রীরা। এতে হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। এমনকি ওই কক্ষের ফাঁকা একটি আসনেও কাউকে উঠতে দেন না তামান্না। এই কমিটিতে তিনি সহসভাপতির পদ পেয়েছেন।

সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে মিশু সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন। বিভাগ থেকে ড্রপ-আউট হয়ে ছাত্রত্ব হারিয়েছেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে আবাসিক হলে সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি ও দোকান ভাঙচুরের অভিযোগ রয়েছে। এই কমিটিতে তাঁকে সহসভাপতি করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক যাচাই-বাছাই করেই কমিটি ঘোষণা করেছেন বলে দাবি নতুন কমিটির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানের। নতুন কমিটির বিষয়ে বিদায়ী কমিটির সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে মতামত দিতে চাচ্ছি না।’