পচা মাছ, মাছের নাড়িভুঁড়িসহ উচ্ছিষ্ট রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করা হচ্ছে। এরপর তাতে লবণ, ময়দা, খইল, ভুসি, ঝিনুক মিশিয়ে চূর্ণ করা হচ্ছে মেশিনে। পরে মিহি হয়ে যাওয়া গুঁড়া বিক্রির জন্য বস্তাভর্তি করছেন শ্রমিকেরা। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে শ্রমিকদের এই কর্মযজ্ঞ দেখা যায় কক্সবাজারের নাজিরারটেকের মোস্তাইক্যা পাড়ায়।
যেই গুঁড়া তৈরিতে শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততা দেখা গেছে, তা পরিচিত শুঁটকিগুঁড়া নামে। মাছের খাদ্য হিসেবে সারা দেশে বিক্রি হয় এসব শুঁটকিগুঁড়া। সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত এসব গুঁড়া তৈরির মৌসুম।
ব্যবসায়ীরা জানান, সারা দেশে শুঁটকিগুঁড়ার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। গত মৌসুমে মোস্তাইক্যা পাড়ার ৫২টি মহালে অন্তত ১১০ কোটি টাকার শুঁটকিগুঁড়া উৎপাদিত হয়েছিল। চলতি মৌসুমে উৎপাদন চলছে ৬৮টি মহালে। এবার অন্তত ১৫০ কোটি টাকার শুঁটকিগুঁড়া বিক্রি হবে বলে আশাবাদী ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিনে মোস্তাইক্যা পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, সড়কের দুই পাশে বিশাল এলাকাজুড়ে শুঁটকিগুঁড়া উৎপাদনের ধুম। এতে চারপাশে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। শ্রমিকেরা রোদে শুকিয়ে পচা মাছ শুঁটকি করছেন। শুকাতে দেওয়া মাছের বেশির ভাগই ছোট মাছ। বড় মাছের উচ্ছিষ্টও রয়েছে। এ ছাড়া বিষাক্ত পটকা মাছ শুকিয়েও শুঁটকি করতে দেখা যায়।
সড়কের উত্তর পাশে একটি শুঁটকিমহালে বিষাক্ত পটকা মাছ শুকানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন শ্রমিক জাহিদ হোসেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুঁটকিগুঁড়া তৈরির জন্য ১২ মণ ওজনের এসব পটকা মাছ চট্টগ্রাম থেকে আনা হয়েছে। পটকা মাছ দিয়ে তৈরি করা শুঁটকিগুঁড়া মাছের জন্য ক্ষতিকর কি না, তাঁর জানা নেই।
পাশের আরেকটি মহালে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল মাঠজুড়ে ছোট ছোট মাছ শুঁটকি হচ্ছে। মাছের ওপর মশা-মাছির উৎপাত লেগে আছে। পাশে দাঁড়ানো রয়েছে একটি ট্রাক। শ্রমিকেরা শুঁটকিগুঁড়া বস্তায় ভরে ট্রাকটিতে তুলে দিচ্ছেন। ট্রাকটিতে করে শুঁটকিগুঁড়া নিতে কুমিল্লা থেকে এসেছেন সারোয়ার আলম নামে এক ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, প্রতি মাসে তিনি মোস্তাইক্যা পাড়া থেকে পাঁচ-ছয় ট্রাক শুঁটকিগুঁড়া তিনি কুমিল্লায় নিয়ে যান। সেখানে মাছের খাদ্য হিসাবে শুঁটকিগুঁড়া বিক্রি করেন।
মোস্তাইক্যা পাড়া সড়কের দক্ষিণ পাশে বিশাল মাঠজুড়ে শুঁটকিগুঁড়ার মহাল—একাকিত্ব এন্টারপ্রাইজ। মহালের শ্রমিকেরা জানান, তাঁরা কুমিল্লা, নোয়াখালী ও নরসিংদী এলাকায় মূলত শুঁটকিগুঁড়া সরবরাহ করেন। ব্যবসায়ীরা মহালে এসে শুঁটকিগুঁড়া কিনে নিয়ে যান। প্রতি কেজি শুঁটকিগুঁড়া বিক্রি হয় ৬০-৮০ টাকায়। এক কেজি শুঁটকিগুঁড়া তৈরি করতে কাঁচা মাছ লাগে আড়াই থেকে তিন কেজি। প্রতি কেজি কাঁচা মাছের দাম পড়ে ২০-৩০ টাকা।
একাকিত্ব এন্টারপ্রাইজের মালিক ওসমান সরওয়ার বলেন, সারা দেশে শুঁটকিগুঁড়ার চাহিদা বাড়লেও মাছের সংকটের কারণে উৎপাদন সেভাবে বাড়ছে না। ১০ বছর আগেও মাত্র দুটি মহালে শুঁটকিগুঁড়ার উৎপাদন শুরু হয়। এখন ৬০টির বেশি মহালে শুঁটকিগুঁড়ার উৎপাদন হচ্ছে।
মহাল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুঁটকিগুঁড়া তৈরির জন্য কক্সবাজারের মহালগুলোতে অন্তত ৭০ শতাংশ মাছ আনা হয় চট্টগ্রাম শহর ও বাঁশখালী এলাকা থেকে। এতে পরিবহন খরচ বেশি লাগায় শুঁটকিগুঁড়ার দামও বেড়ে যাচ্ছে। শ্রমিকেরা জানান, মোস্তাইক্যা পাড়ায় শুঁটকিগুঁড়া উৎপাদন, বিপণন ও সরবরাহে শ্রমিক হিসেবে রয়েছেন অন্তত ১২ হাজার মানুষ। তাঁরা ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা মজুরি পান।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, শুঁটকিগুঁড়া মিহি করে ফেলার কারণে মাছের পোনারও এই খাদ্য খেতে সমস্যা হয় না। মাছ দিয়ে তৈরি হওয়ায় এ ধরনের গুঁড়াতে প্রোটিন বেশি থাকে, যার কারণে মাছের ওজন দ্রুত বৃদ্ধি পায়। তাই সারা দেশেই শুঁটকিগুঁড়ার চাহিদা বেড়ে চলছে। দেশে কেবল কক্সবাজারেই শুঁটকিগুঁড়া উৎপাদন হয়।
পটকা মাছ মেশানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষাক্ত পটকা মাছ খেলে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। তাই এটি ঘেরের মাছের জন্যও ক্ষতিকর হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। পটকা মাছ মেশানো হচ্ছে কি না, তা মহালগুলোয় অনুসন্ধান করা হবে।