বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকার সড়ক থেকে বন্যার পানি নেমে গেলেও আজ বৃহস্পতিবারও সারা দেশের সঙ্গে জেলার পরিবহন যোগাযোগ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। বান্দরবান-কেরানীহাট-চট্টগ্রাম সড়কের সাতকানিয়া ও চন্দনাইশ এলাকার কিছু অংশ এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। এর মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী কিছু বাস ও ট্রাক চলাচল করছে। এদিকে বন্যার পর বান্দরবান জেলা শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
বেলা ১১টায় বাসস্ট্যান্ডে শত শত মানুষকে যানবাহনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। পটিয়া যাওয়ার জন্য বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিলেন মিহির কান্তি দত্ত। তিনি বলেন, এক ঘণ্টা ধরে গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু কেরানীহাটের দিকে গাড়ি যাচ্ছে না।
ঢাকার গাড়ির অপেক্ষায় থাকা শহিদুল ইসলাম বলেন, পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসে পাঁচ দিন ধরে বান্দরবান শহরে আটকে আছেন। গতকাল বুধবার ঢাকার গাড়ি ছাড়ার কথা ছিল। কিন্তু ছাড়েনি। আজও কাউন্টারের লোকজন বলছেন, যাত্রী হলে রাতে বাস যাবে। সবকিছু যে যার খেয়ালখুশিমতো চালাচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তবে শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টার ইনচার্জ রফিকুল ইসলাম বলেন, গতকাল থেকে তাঁদের গাড়ি চলছে। ঢাকা থেকে আসা একটি বাস সকালে বান্দরবান ছেড়ে গেছে। আজ রাতেও বাস ছাড়বে।
বান্দরবান থেকে চট্টগ্রামে নিয়মিত চলাচল করা বাসগুলো চলছে না। পূর্বাণী বাসের চালকের সহকারী নাজিম উদ্দিন বলেন, বাসের টিকিট কাউন্টার, চালক ও চালকের সহকারীদের ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। তাঁরা এখন কাদা পানি সরাতে ব্যস্ত। তা ছাড়া বান্দরবান অংশের পানি সরে গেলেও সাতকানিয়া ও চন্দনাইশে সড়ক এখনো ডুবে আছে। কেউ কেউ ঝুঁকি নিয়ে চালাচ্ছেন। গাড়ির কোনো ক্ষতি হলে কোম্পানি দায় নেবে না। এ জন্য সবাই চালাচ্ছেন না। তবে কাল শুক্রবার থেকে বান্দরবান-চট্টগ্রাম ও বান্দরবান-রাঙামাটি গাড়ি চলাচল করতে পারে তিনি জানান।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফারহান বলেন, বান্দরবান-কেরানীহাট-চট্টগ্রাম সড়কের বান্দরবান অংশ বা বান্দরবান-রাঙামাটি সড়কে কোনো সমস্যা নেই। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের গাড়ি না চালানোর কারণ তাঁর জানা নেই। বান্দরবান-রোয়াংছড়ি সড়ক আগামী শনিবার খুলে দেওয়া হবে। বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কে সেনাবাহিনী কাজ করছে বলে তিনি জানান।
এদিকে জেলা প্রশাসনের বন্যানিয়ন্ত্রণ কক্ষের দায়িত্বরত ব্যক্তিরা জানান, আজ পর্যন্ত জেলায় পাহাড়ধস, পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভেসে এবং মাটির ঘর ভেঙে আটজনের মৃত্যু হয়েছে। দুজন নিখোঁজ আছেন ও আহত হয়েছেন ১৭ জন। আজ দুপুরে বান্দরবান সদর ইউনিয়নের ছায়াবি তঞ্চঙ্গ্যা নামের এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি পাহাড়ি বনে বাঁশকোড়ল খুঁজতে গিয়ে ১০ আগস্ট নিখোঁজ হয়েছিলেন। এ নিয়ে বান্দরবান সদরে ৪, আলীকদমে ২, লামা ও নাইক্ষ্যংছড়িতে ১ জন করে মারা গেছেন। সাত উপজেলায় ২০৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২১ হাজার ৭৯৭ জন আশ্রয় নিয়েছিলেন। দুর্গত মানুষদের জন্য এ পর্যন্ত ১৬৮ টন চাল ও ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
পাহাড়ি ঢলের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত লামা উপজেলা। উপজেলা সদরের ৮০ শতাংশ এলাকা তিন দিন ধরে পানিতে ডুবেছিল। লামা পৌরসভার মেয়র জহিরুল ইসলাম বলেন, বন্যাপরবর্তী বড় সমস্যা বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ পানি। বিশুদ্ধ পানির সংকট মোকাবিলায় কক্সবাজার থেকে কাল একটি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র নিয়ে আসা হবে। খাদ্যগুদাম ডুবে যাওয়ায় ১৪০ টন খাদ্যশস্য ভিজে গেছে।
লামা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা জামান বলেন, উপজেলার নিচু এলাকাগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তাৎক্ষণিকভাবে নিরূপণ করা না গেলেও অন্তত সাড়ে তিন হাজার পরিবার গৃহহীন হয়েছে। ১৫০টির মতো মাটির গুদাম ধ্বংস হয়েছে।
টানা চার দিন বন্ধ থাকার পর আজ বিকেল ৫টা ৪১ মিনিটে জেলা শহরের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সরবরাহ উপকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী দীপ্ত চক্রবর্তী বলেন, দুই দিন ডুবে থাকা সরবরাহ উপকেন্দ্রটি বিশেষজ্ঞ দলের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চালু করা হয়েছে। আপাতত শুধু জেলা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। ক্ষতিগ্রস্ত সঞ্চালন লাইন সংস্কারের পর উপজেলায় সরবরাহ চালু করা সম্ভব হবে।
জেলা শহরের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ও বাসাবাড়িতে বন্যার শুরু থেকে পানির সংকট চলছে। পৌর ভবনের সামনে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। সেখানে সারা দিন নারীদের দীর্ঘ সারি লেগে থাকে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী খোরশেদ আলম বলেন, কক্সবাজার থেকে দুটি পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র এনে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হচ্ছে। এখন বিদ্যুৎ চালু হওয়ায় পৌরসভার পানি সরবরাহ ব্যবস্থাও চালু করা হবে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, পানি নেমে যাওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্রের লোকজন বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন। বিদ্যুৎ না থাকায় পানির কিছুটা সমস্যা হয়েছিল। তবে সেনাবাহিনী, প্রশাসন পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করেছে। আজও ১ লাখ ৬০ লিটার পানি বিতরণ করা হয়েছে। আজ বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু হওয়ায় পানির সমস্যা আর থাকবে না বলে তিনি জানান।