চট্টগ্রাম নগরের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের আরও এক দফা বড় ধরনের নকশা পরিবর্তন হচ্ছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে এবার ছয়টি র্যাম্প বাদ দেওয়ার চিন্তা করছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এই ব্যাপারে সিডিএর বোর্ড সভায় প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কাল সোমবার এ সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সিডিএতে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। আগের বোর্ড সদস্যদের বাদ দিয়ে নতুন সদস্য নিয়োগ করে তা পুনর্গঠন করা হয়। সিডিএতে এমন পরিবর্তনের পর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনা শুরু হয়। এ ছাড়া আগে থেকেই র্যাম্প নিয়ে পরিবেশবাদী, ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীদেরও আপত্তি রয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে নাগরিক ও পেশাজীবী সমাজের সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা না করার অভিযোগ রয়েছে সিডিএর বিরুদ্ধে। সিডিএ রাজনৈতিক বিবেচনায় ‘ইচ্ছেমতন’ যেখানে-সেখানে র্যাম্প দেওয়া হয়েছিল। তবে সিডিএর প্রকৌশলীদের দাবি, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান যাচাই-বাছাই করে র্যাম্পের স্থান নির্ধারণ করেছে। সেভাবে নকশা করা হয়েছে।
সিডিএ সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে নগরের লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত চট্টগ্রামে প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সিডিএর ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকার এই প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয় ২০১৭ সালের আগস্টে। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। এখন প্রকল্প ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। এটির নামকরণ করা হয় মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী-সিডিএ এক্সপ্রেসওয়ে। চলতি বছরের ২৮ আগস্ট থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে পরীক্ষামূলক যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে।
নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান যাচাই-বাছাই করে ১৫টি র্যাম্পের স্থান নির্ধারণ করেছিল। সে অনুযায়ী নকশা চূড়ান্ত করা হয়। তবে বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা ছয়টি র্যাম্প নির্মাণের ব্যাপারে আপত্তি দিয়েছে। সিডিএর বোর্ড সভায় এই প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। বোর্ড সদস্যরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
প্রকল্প অনুমোদনের প্রায় দুই বছর পর ২০১৯ সালে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ শুরু হয়। তবে প্রথম থেকেই নকশা ও নির্মাণকাজ নিয়ে ধাপে ধাপে জটিলতা দেখা দেয়। প্রথমে নগরের লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করার কথা ছিল। তবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বিমানবন্দর পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে বাধা দেয়। এরপর পতেঙ্গায় নামিয়ে দেওয়া হয় একটি প্রান্ত।
এদিকে নির্মাণকাজ চলাকালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও নগর পুলিশের পক্ষ থেকে আপত্তি ছিল। বিশেষ করে নগরের সল্টগোলা থেকে বারিক বিল্ডিং মোড় পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের নকশা নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের তীব্র বাধা ছিল। দফায় দফায় বৈঠক করে তা সংশোধন করা হয়।
বাদ যাচ্ছে যে ছয়টি র্যাম্প
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আপাতত ছয়টি র্যাম্প নির্মাণ না করার চিন্তা করছে সিডিএ। এগুলো হচ্ছে নগরের টাইগারপাসের মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী সড়কের পলোগ্রাউন্ড থেকে পতেঙ্গামুখী র্যাম্প; মূল এক্সপ্রেসওয়ে থেকে আগ্রাবাদে জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের সামনে নামার র্যাম্প; আগ্রাবাদের অ্যাকসেস রোডে ওঠানামার দুটি র্যাম্প, সিডিএ অ্যাভিনিউর জিইসি মোড় এলাকা থেকে মূল এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার একটি র্যাম্প এবং সিমেন্ট ক্রসিং মোড় এলাকায় নামার র্যাম্প।
টাইগারপাসের মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী সড়কের পলোগ্রাউন্ড থেকে পতেঙ্গামুখী র্যাম্প নির্মাণ নিয়ে আপত্তি জানিয়ে চলতি বছর এপ্রিলে আন্দোলন শুরু করেন পরিবেশকর্মীরা। সবুজে ঘেরা অনন্য এই সড়কের একটি অংশ গেছে পাহাড় ঘেঁষে। আরেকটি অংশ নিচে। মধ্যবর্তী পাহাড়ি ঢালে রয়েছে ছোট-বড় শতাধিক বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এসব গাছে রয়েছে নানা প্রজাতির পাখির বাসা। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প (গাড়ি ওঠার পথ) নির্মাণ করতে গাছগুলো কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সিডিএ। এ জন্য বন বিভাগের অনুমোদনও নেয়। আর কাটতে যাওয়া গাছগুলোয় লাল ও সাদা কালি দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
র্যাম্প নির্মাণের জন্য ঐতিহ্যবাহী দ্বিতল সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত করা এবং ছোট-বড় গাছ ৪৬টি কাটা হবে—গণমাধ্যমে এই সংবাদ প্রকাশিত হলে নগরবাসীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। আন্দোলনের মুখে র্যাম্প নির্মাণ থেকে পিছু হটে সিডিএ।
এদিকে নগরের সিডিএ অ্যাভিনিউর জিইসি মোড় থেকে পতেঙ্গামুখী একটি ওঠার র্যাম্পের নির্মাণকাজ শুরু করেছিল চলতি বছরের এপ্রিলে। তবে এই র্যাম্পের নির্মাণকাজ বন্ধের দাবি জানিয়ে গত ২৩ মে সিডিএকে চিঠি দিয়েছিল বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ (বাওয়া)। বর্তমানে এই র্যাম্পের নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে।
এই ছয়টির বাইরে আগ্রাবাদ ডেবারপাড় থেকে পতেঙ্গা একটি র্যাম্প নির্মাণে আপত্তি জানিয়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এই র্যাম্পটি নির্মাণ করা হলে ৫৯টি দোকান উচ্ছেদ করতে হবে।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও সিডিএর নতুন বোর্ড সদস্য নগর পরিকল্পনাবিদ জেরিনা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রয়োজন না থাকলেও এক্সপ্রেসওয়েতে ১৫টি র্যাম্প রাখা হয়েছে। এমনিতেই নগরে যানজট বাড়ছে। র্যাম্পগুলো নির্মাণ করা হলে যানজট আরও বেড়ে যাবে।