দুই বছরে পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুতের ১২৭টি ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে। ট্রান্সফরমার চুরি করতে গিয়ে পিটুনিতে একজন মারাও গেছেন।
বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার চুরি নিয়মিত রূপ নিয়েছে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায়। ট্রান্সফরমার চুরি করতে গিয়ে চলতি বছর গণপিটুনিতে একজন নিহত হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এ উপজেলায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুতের ১২৭টি ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনা ঘটেছে।
উপজেলার রাওনা ইউনিয়নের দীঘা গ্রাম থেকে ১৩ ডিসেম্বর রাতে ছয়টি ট্রান্সফরমার চুরি হয়। ছয়টি ট্রান্সফরমারে এলাকাটির প্রায় ১৫০ একর জমিতে সেচ দেওয়া হতো। ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনায় সাবেক পুলিশ সদস্য মাকছুদুল ইসলাম বাদী হয়ে পরের দিন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে থানায় অভিযোগ দিয়েছেন। দীঘা গ্রামে ট্রান্সফরমার চুরি হওয়ার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, খুঁটিতে ট্রান্সফরমার থাকলেও ভেতর থেকে খুলে নেওয়া হয়েছে তামার তার। নিচে পড়ে আছে কিছু ধাতব জিনিস। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করছেন পুলিশের একটি দল।
চুরি হওয়া তিনটি ট্রান্সফরমার দিয়ে সেচ দিতেন মাকছুদুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আগামী এক সপ্তাহ পর বোরো মৌসুমের জন্য সেচ শুরু হতো। তিনটি ট্রান্সফরমার নতুন করে কিনতে ১ লাখ ৩৭ হাজার টাকা দরকার। কিন্তু চোর চক্র খুঁটিতে ট্রান্সফরমার রেখে ভেতর থেকে তামার তার বের করে নিয়ে গেছে। আমরা চাই এ ঘটনায় জড়িতরা দ্রুত আইনের আওতায় আসুক।’
ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর গফরগাঁও আঞ্চলিক কার্যালয়ের আওতায় উপজেলায় গ্রাহক রয়েছেন প্রায় ৬৬ হাজার ৩৬ জন। এর মধ্যে সেচ গ্রাহক রয়েছেন প্রায় ৯০০ জন। সেচকাজে ব্যবহৃত পল্লী বিদ্যুতের বেশির ভাগ ট্রান্সফরমার মাঠে নির্জন স্থানে স্থাপন করা হয়। ২০২৩ সালে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৫, ১৫, ১০ ও ৫ কেভি ক্ষমতাসম্পন্ন ৬১টি ট্রান্সফরমার এবং চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০টি ট্রান্সফরমার চুরি হয়। প্রায় দুই বছরে ১০১টি ট্রান্সফরমার চুরি হয় পল্লী বিদ্যুতের।
পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, চুরি হওয়ার পর ট্রান্সফরমার প্রতিস্থাপন করতে সাধারণ গ্রাহকের অর্ধেক মূল্য দিয়ে প্রথমবার ও দ্বিতীয়বার চুরি হলে পুরো মূল্য দিতে হয়। আর সেচের বেলায় চুরি হওয়ার পর পুরো মূল্য দিয়ে নতুন ট্রান্সফরমার কিনে স্থাপন করতে হয়। চুরি হওয়ার পর ট্রান্সফরমার কেনার টাকা জোগাড় হতে দেরি হওয়ায় ট্রান্সফরমার পুনঃ স্থাপনেও বিলম্ব হয়। এতে গ্রাহক ও কৃষকেরা পড়েন দুর্ভোগে।
ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২–এর গফরগাঁও আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. জিয়াউর রহমান খান বলেন, ট্রান্সফরমার চুরির পর প্রতিটি ঘটনায় থানায় জিডি করা হয়। ট্রান্সফরমারের ভেতরে থাকা কয়েলের জন্যই চুরির ঘটনা ঘটে। চোর চক্র গাজীপুর ও কিশোরগঞ্জ এলাকা থেকে আসে, এলাকার কিছু লোকও জড়িত। শীত মৌসুমে চুরির প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। মাঝে কিছু সময় চুরি কমলেও আবার বেড়েছে। চুরি রোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতা চান পল্লী বিদ্যুতের ওই কর্মকর্তা।
অপর দিকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণের (পিডিবি) আওতাভুক্ত গফরগাঁওয়ে সংযোগ লাইন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়ে গাজীপুরের টোক পর্যন্ত। এ এলাকায় ৪২০ কিলোমিটারজুড়ে রয়েছে লাইন। গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৭১ হাজার। পুরো এলাকায় বর্তমানে ৭৬৩টি ট্রান্সফরমার রয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২৬টি বিভিন্ন আকারের ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে ১৪টি এবং চলতি বছর ১২টি ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে।
পিডিবি জানিয়েছে, উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়ের ভরভরা টাওয়ারের মোড় এলাকায় ২৯ নভেম্বর ৫০ কেভি ট্রান্সফরমারের কয়েল চুরি হয়। একই ইউনিয়নের গোপপাড়া এলাকায় ১০০ কেভি ট্রান্সফরমার গত ২২ নভেম্বর খুলে ভেতরে থাকা তামার তার নিয়ে যায়। ১২ ডিসেম্বর ত্রিশালের ইছমতি এলাকার ২৫০ কেভি ট্রান্সফার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও বিদ্যুৎ বিভাগের তৎপরতায় নিতে পারেনি।
পিডিবির গফরগাঁও বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোশারফ হোসেন বলেন, ‘এসব ঘটনায় নিয়ম অনুযায়ী সাধারণ ডায়েরি করা হয়, কিন্তু চোর ধরা পড়ছে না। এটা সবার জন্য ভোগান্তি।’
গত ২৩ নভেম্বর গফরগাঁও পিডিবি নিজেদের ফেসবুকে জরুরি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। পিডিবির গফরগাঁও বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোশারফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের একার পক্ষে চুরি রোধ সম্ভব নয়, সে কারণে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে বিশেষ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।’
চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল রাতে গফরগাঁওয়ের নিগুয়ারি ইউনিয়নের বেলদিয়া এলাকায় মো. নবীন মিয়া (৪২) নামের এক ব্যক্তি গণপিটুনিতে মারা যান। ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২–এর গফরগাঁও আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. জিয়াউর রহমান খান বলেন, গণপিটুনিতে একজনের মৃত্যুর পর পুরো উপজেলায় ট্রান্সফরমার চুরি একদমই বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এখন আবার বেড়েছে।
এ বিষয়ে গফরগাঁও থানার ওসি শিবিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘চুরি রোধে আমাদের টহল কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। আশপাশের চোরদেরও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। চুরি রোধে পুরো এলাকায় পুলিশের টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে।’